বাংলা সিনেমার বিকাশ

নাহ্ এই প্রতিবেদন বাংলা ছায়াছবির ইতিহাস কে নিয়ে নয় বিকাশ কে নিয়ে, হ্যাঁ বিকাশ! বিকাশ রায়, নিজের সত্তর বছরের জীবনের প্রায় অর্ধেকটাই যিনি অতিবাহিত করেছিলেন পর্দায় অথবা মঞ্চে, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, দৃপ্ত বাচনভঙ্গি সবকিছুতেই তিনি ছিলেন একটু অন্যরকমের, মানে কিছু জিনিস সম্পর্কে যেমন বলা হয়না যে অমনটি আর হয়না খানিকটা সেই গোছের। জন্ম ১৯১৬ সালের ১৬ই মে, ১৯৮৭তে দেহাবসান-এর আগে অবধি তিনি চিত্রাভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, মঞ্চাভিনেতার ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন সুচারুভাবে।

     সিনেমার জগতে তিনি সাধারণত পরিচিত ছিলেন খলনায়কের চরিত্রে দৃপ্ত অভিনয়ের জন্য, অনেকেই "৪২"এর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন কিন্তু চরিত্রাভিনেতা হিসাবে যে কোনো ধরনের চরিত্রেই তিনি ছিলেন যথাযথ, 'সূর্যতোরণ' সিনেমায় উত্তম, সুচিত্রা,  কমল মিত্র, তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতাদের পাশে বিকাশ রায়ের অভিনয় মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো, সেই অর্থে নায়কের ভূমিকায় কোনদিন বিকাশ রায়কে না দেখা গেলেও নায়কোচিত অভিনয়েই তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন, সূর্যতোরণে সিনেমার প্রথমার্ধে উনি খলনায়কের চরিত্রে আর সেই সিনেমার শেষেই উনি নায়ক উত্তম কুমারকে ছাপিয়ে গিয়ে দর্শকদের মধ্যে গভীর ছাপ বিস্তার করে যান, অথবা 'উত্তর ফাল্গুনী', একজন বিচক্ষণ, প্রাজ্ঞ, সৎ আইনজীবীর চরিত্রে বিকাশ রায়ের অভিনয়, একজন মানুষের নিষ্ঠা প্রেম অসহায়তা এমন জীবন্ত চিত্রায়ণ হয়তো কেবল বিকাশ রায়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল, নায়ক হতে গেলে কী আরও বেশি কিছু লাগে? উত্তর প্রতিবেদকের জানা নেই।উত্তম কুমারের সাথে আরও বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন বিকাশ রায়, অভিনয় দক্ষতায় নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন সদম্ভে, ছাপিয়ে গেছেন নিজের অনুজ প্রতিমকে, 'জীবনতৃষ্ণা' ছায়াছবিতে বিকাশ রায় ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় বারবার স্পটলাইট কেড়ে নিয়েছে উত্তম-সুচিত্রা জুটির|

        উত্তম কুমার অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন বিকাশ রায়কে, দুজনের সম্পর্ক ছিল দাদাভাইয়ের মতনই, একই কথা প্রযোজ্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও, সৌমিত্রর কেরিয়ারের প্রথম দিকের দুটি ছবি 'প্রস্তরস্বাক্ষর' এবং 'কাঁচকাটা হিরে' তে সৌমিত্রর সহঅভিনেতা ছিলেন বিকাশ, নায়ক সৌমিত্র হলেও বিকাশ রায় ছিলেন সিনেমার দুটির কেন্দ্রে, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সাথে 'আরোগ্যনিকেতন' আর অনুপকুমারের সঙ্গে 'জীবনকাহিনী'তেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। চলচ্চিত্র জগতে আসার আগে বিকাশ ছিলেন আকাশবাণীর পরিচিত মুখ, শ্রুতিনাটকে অভিনয় এবং পরিচালনা দুই করেছিলেন, ১৯৪৭ সালে হেমেন গুপ্ত পরিচালিত 'অভিযাত্রী' ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন বিকাশ রায়, হেমেন গুপ্তর পরিচালনাতেই অভিনয় করেছেন কিংবদন্তী বাংলা ছবি '৪২' এবং 'ভুলি নাই' একজনই অভিনেতা দুই ভিন্ন ধারার পরিচালকের সাথে সমান্তরাল ভাবে কাজ করে গিয়েছেন, মৃণাল সেনের পরিচালনায় 'নীল আকাশের নিচে' ছবিটিতে বিকাশ রায়ের অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন মৃণাল সেন স্বয়ং, তপন সিংহ জানান বিকাশ ছিলেন একজন মেথড অ্যাক্টর, একবার যদি চরিত্রের বিষয়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যেত তাহলে বাকিটা উনি নিজেই ছাঁচে ফেলে গড়ে নিতেন। কষ্ট করে শিখেছিলেন সিনেমা মেকিং এর কলাকৌশল, প্রতিষ্ঠা করেন "বিকাশ রায় প্রোডাকশন", অবধূতের কাহিনী 'মরুতীর্থ হিংলাজ"কে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেলুলয়েডে, সামান্য প্রযুক্তি আর অর্থের সাহায্যে এই ছবি যতটা নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল তা কুর্নিশ করার মত। তিন দশকের বেশি সময়ের কেরিয়ারে প্রায় আড়াইশোটি ছায়াছবিতে অভিনয় করেছেন বিকাশ রায়, প্রথম দিকের কয়েকটি ছবিতে নায়কও হয়েছিলেন বিকাশ রায়, অরুন্ধতী দেবীর সঙ্গে 'ছেলে কার' অথবা 'রাত্রির তপস্যা', 'রত্নদীপ' প্রভৃতি বক্স অফিসে কিছু কিছু সাফল্যও পায়। ওঁর অভিনীত ছবি গুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় "৪২"। এই সিনেমায় মেজর ত্রিবেদীর চরিত্রে তাঁর জীবন্ত অভিনয় দেখে দর্শকরা ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়তো, আবার 'ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদি'তে বিকাশ রায় একজন ধূর্ত চরিত্রহীন সাপুড়ে, শুধুমাত্র চোখের চাহনিতেই বিষ উগরে দিয়েছেন, আবার 'বিভাস' ছবিতে এই বিকাশ রায় ঠান্ডা রক্তের খলনায়ক, অদ্ভুত ভাবে এই সিনেমায় বিকাশ রায় ছিলেন পার্শ্ব খলনায়ক, কিন্তু তার শীতল অভিনয়ে কখনো কখনো ছাপিয়ে গিয়েছেন প্রধান খলনায়ক কমল মিত্রকে। এইসবের পাশাপাশি 'দুই পুরুষ', 'বিন্দুর ছেলে' প্রভৃতি সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, তার কাহিনী নিয়েই তৈরি হয়েছে উত্তম কুমার অভিনীত 'রাজাসাজা' সিনেমাটি। ব্যক্তিগত জীবনে লেখালেখি করতে খুব পছন্দ করতেন, লিখেছেন আত্মজীবনী 'মনে পড়ে', 'আমি' আর 'কিছু ছবি কিছু গল্প'-এর মতন বই, বাড়িতে ছিল অনেক আলমারি ভর্তি বই, মনে করতেন যে কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে শেকসপিয়র আর রবীন্দ্রনাথের বই অবশ্যই থাকা উচিত। উনি যে রুচির মানুষ ছিলেন আর যে জাতের অভিনেতা ছিলেন দুটিই বর্তমানে বিরল, তাঁর কাজের মাধ্যমেই তিনি থেকে যাবেন ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...