লোকসমাজে দেবী দুর্গার মাটির মূর্তি তৈরি করে পুজো এবং তা বিসর্জনের ঐতিহ্য নির্মাণ করেছিলেন রাজা সুরথ ও বণিক সমাধি। এ-তথ্য আমরা পাচ্ছি 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ' থেকে।
প্রতিমা বিসর্জনের সেই ঐতিহ্য কালক্রমে আভিজাত্য, দেখনদারি ও রেষারেষির সামগ্রী হয়ে উঠল উনিশ শতকে এসে। অবশ্য এর সূত্রপাত আঠের শতকে, ইংরেজের বদান্যতায় যখন মীরজাফর ও মীরকাশেমরা হলেন 'হঠাৎ নবাব', আর নবকৃষ্ণ দেবের মতো মানুষেরা হলেন হঠাৎ রাজা।
বাঙালির দুর্গা পুজো এই সময় ইংরেজের কাছে বেশ আমোদের সামগ্রী হয়ে উঠেছিল। হয়ে উঠেছিল রবার্ট ক্লাইভের ঐকান্তিক অভিলাষে। পলাশীর যুদ্ধে জিতে ষড়যন্ত্র-সহায়তার পুরস্কার দিতে কোম্পানির মুনশি নবকৃষ্ণদেবকে প্রথমে তিনি শোভাবাজারের রাজা করে দিয়েছিলেন। তারপর যুদ্ধজয়কে সেলিব্রেট করতে নবকৃষ্ণকে আদেশ দিয়েছিলেন দুর্গা পূজার আয়োজন করতে।
কর্তার কথা মুখ থেকে খসতে-না-খসতেই নবকৃষ্ণ রাতারাতি ঠাকুরদালান তৈরি ফেলেছিলেন। সেই সঙ্গে এককাঠি এগিয়ে বানিয়ে ফেলেছিলেন একখানা নাচঘরও।
বলা বাহুল্য, ঠাকুরদালানে দুর্গা পুজোর আয়োজন হয়েছিল মহা ধুমধাম করে। আর নাচঘরে বসেছিল বাঈনাচের জমাটি আসর। সঙ্গে দেদার খানা এবং পিনা। হাতির পিঠে চড়ে তাতে যোগ দিতে ক্লাইভ এসেছিলেন, হেস্টিংস এসেছিলেন; একশ এক টাকা দক্ষিণা দিয়েছিলেন, গিয়েছিলেন দিল খুশ করে। এখান থেকে বাঙালির দুর্গা পুজোয় ইংরেজের রবরবা শুরু হয়েছিল।
এই সময় নবকৃষ্ণর দেখাদেখি সুবিধাবাদী জমিদারগোছের অভিজাত পরিবারের সমস্ত ভদ্রাসনেই একটি করে ঠাকুরদালান তৈরি হল, দুর্গা পুজোর ঐতিহ্য শুরু হল এবং তাতে উচ্চপদস্থ ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বেশ খাতির করে তাদের নেকনজরে থাকার প্রতিযোগিতা শুরু হল। ব্যাপারটা এমন বাড়াবাড়ি জায়গায় পৌঁছল যে, কোম্পানিকে আইন করে বাঙালির পুজোয় ইংরেজের অংশগ্রহণ ঠেকাতে হল।
আইন করে অভিজাত বড়লোকের পুজোয় ইংরেজের রবরবা না-হয় বন্ধ হল; কিন্তু তাতে পুজোকে কেন্দ্র করে অভিজাতে অভিজাতে রেষারেষি বন্ধ তো হলই না, বরং বাড়ল। সেই সঙ্গে পাল্লা দিল জাঁকজমকে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার ঐতিহ্যও। যেমন, জোড়াসাঁকোর দুই অভিজাত পরিবারের মধ্যে দুর্গা পূজায় আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা ছিল দেখার মতো।
জোড়াসাঁকোর ওই দুই পরিবারের একটি হল ঠাকুর পরিবার, অন্যটি গন্ধবেনে দাঁ-পরিবার।
ঠাকুর পরিবারের নীলমণি ঠাকুর থেকে শুরু করে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়কাল অব্দি ঠাকুরদালানে বেশ ধুমধাম করে দুর্গা পুজো হত। তাঁরা ছিলেন বৈষ্ণব। ফলে পুজো হত বৈষ্ণব মতে। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হয়ে মূর্তিপুজোর এই ঐতিহ্য থেকে সরে আসেন এবং 'মাঘোৎসব'-এর প্রবর্তন করেন।
যাই হোক। ফের ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দাঁ-পরিবারের দুর্গা পুজোর রেষারেষির কথায় ফিরে আসি :
ঠাকুর পরিবারের দুর্গা প্রতিমাকে পরানো হত খাঁটি সোনার গয়না। ফলে, তাঁদের টেক্কা দিতে দাঁ-পরিবারের শিবকৃষ্ণ দাঁ একবার করলেন কী, প্যারিস থেকে হিরে-মুক্তো প্রভৃতি দামি পাথরে অলংকৃত সোনার গয়না আনিয়ে দেবীকে এমন সাজালেন যে, তাই দেখে সকলের একেবারে তাক লেগে গেল।
ঠাকুর পরিবার ব্যাপার দেখে ভাবতে বসলেন, দাঁ-পরিবারকে কী করে টেক্কা দেওয়া যায়! ভাবতে ভাবতে অবশেষে সুযোগ মিলে গেল বিসর্জনের দিন। ঘাটে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন যে, বিসর্জনের আগে দাঁ-পরিবার দেবীর গায়ের ওইসব মূল্যবান গয়না খুলে রাখছেন। অমনি ঠাকুর পরিবারের কর্তাদের মাথায় চিড়িক মেরে উঠল, দাঁ-দের টেক্কা দিতে সকলকে অবাক করে গা-ভর্তি সোনার গয়না সমেত নিজেদের দুর্গা বিসর্জন দিয়ে দিলেন! আকস্মিক এই ঘটনাটা ঘটতেই চারিদিকে একেবারে ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ রায় বিসর্জনের আভিজাত্যে অভিনবত্ব আনতে একবার গঙ্গার বুকে নৌকোয় চাপিয়ে দেবীকে ভাসানোর সময় সেই নৌকোয় বাঈনাচের আয়োজন করে একেবারে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এটা ১৮৩২ সালের ঘটনা। এ-বছরের ১৩ অক্টোবরের 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় এই ঘটনার বিবরণ আছে।
চোরবাগান ও আমতলার মল্লিকবাড়ির পুজোয় বিসর্জনের সময় জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে ওড়ানো হত নীলকণ্ঠ পাখি।
নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হত কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রতিমা বিসর্জনের সময়েও। একশ আট বাহকের কাঁধে চড়ে বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে জলঙ্গির জলে দেবীর বিসর্জিত হতেন। শঙ্খ, উলুধ্বনি, তোপধ্বনি, ঢাক, সানাইয়ের সমবেত রবে গুলজার হয়ে উঠত জনপদ। শোভাযাত্রায় থাকত বিচিত্র পতাকা নিয়ে সুসজ্জিত কয়েক সহস্র পাইক-বরকন্দাজ। সবার সামনে থাকত সুদৃশ্য সাজে রাজহস্তী। বিসর্জনের সময় রাজা নিজের হাতে ওড়াতেন নীলকণ্ঠ। পাখি বিসর্জনের খবর দিত গিয়ে রাজপুরীতে...
তবে যে যত অভিজাতই হোন-না-কেন, যে-যাঁকেই টেক্কা দিন-না-কেন মোকাম কলিকাতার পথে শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমার শোভাযাত্রা আগে যেত, বিসর্জনও হত আগে। তারপর একে একে আর সব, সেটাই ছিল অলিখিত সরকারি নিয়ম...