পাড়ার প্যান্ডেলে বিসর্জনের বাদ্যি বেজে উঠলেই তাড়া বাড়ে রান্নাঘরে।
কোথায় কাপ? কোথায় ডিশ? কোথায়-ই বা রেকাব কিংবা বাটি, চামচ? সিঁদুর খেলার পর্ব শেষ করেই ঘরে ফেরার ডাক?
একটু পরেই যে কড়া নাড়া শুরু হবে বাড়িতে। যদিও এদিন দরজাটা খুলে রাখাই। কলিং বেলখানা থাকলেও সে আজ ‘রেস্টে’। বিজয়া মানেই অবারিত দ্বার।
ও বাড়ির মুখার্জীদা, পাশের বাড়ির মান্নাদা হয়ে ভিড়টা বদলে যাবে বাবাই-টুবাইদের হট্টগোলে। আত্মীয়-স্বজনদের ঢল। তাই মাকে বরণ করার আগেই সারা বিজয়ার প্রস্তুতি।
বাঙালির বৈঠকখানা তখনও ড্রইংরুম হয়ে ওঠেনি। দরজা তখন উদার। বাড়ি জুড়ে বিজয়া দশমীর ব্যস্ততা।
বৈঠকখানা ঘরে উপচে পড়া ভিড়টার নজর মাঝে মাঝেই চলে যায় হেঁশেলের দিকে। উড়ে আসা নারকেল নাড়ুর গন্ধ। পাঁঠার ঘুগনির টান। মিহিদানা, দরবেশ, চন্দ্রপুলি, গজা আর কুচো নিমকির সঙ্গে বাড়ির তৈরি মুগবরফি, ছাপা সন্দেশ আর এলোঝেলো। কোলাকুলি, প্রণাম পর্ব মিটলেই হাতে প্লেট।
সবই ‘বিজয়া স্পেশাল’। মা দুগগার আশীর্বাদ যেন ছোঁয়া দিয়ে যেত হেঁশেলেও। পুজোর বাজারের সঙ্গে সঙ্গে আলাদা মুদির ফর্দ তৈরি। গুড়, চিনি, নারকেল, ময়দা, ডালডা আসত বিজয়া দশমীর জন্য।
কাঠের বারকোশ, মিষ্টি তৈরীর ছাঁচ বেরতো বাসনের সিন্দুক থেকে। মাঝে-মাঝেই কুরুনিতে নারকেল কোরার ঘসর-ঘসর শব্দ। সময় পেলেই হাতের তালু ব্যস্ত চষি তৈরিতে। শরতের রোদে থালায় থালায় শুকনো হত পায়েসের ‘চাল’ ।
মহালয়ার সময় থেকেই বদলে যেত চেনা রান্না ঘরের গন্ধটা। পড়ন্ত আঁচে জমানো দুধ ফুটে ফুটে ক্ষীরে। নারকেল নাড়ুর মিঠে গন্ধে পুজোর ছুটির টান। ছোলার ডালের তক্তিতে এলাচ মিশলেই মোহময় হয়ে ওঠে গোটা বাড়ির বাতাস। আটপৌরে হেঁশেলটা রাতারাতি বদলে গিয়ে যেন ছোটখাটো ভিয়েন।
বাইরের মিষ্টি দিয়ে বিজয়া সারার কথা ভাবাই যেত না। নিমকি কতটা খাস্তা হয়েছে আর এলেঝেলোর ঝগড়া হবে কিনা তার পুরোটাই নির্ভর করছে রাঁধুনীর হাতের যাদুতে।
শুধু পাঁঠার ঘুগনির টানে দলে ভিড়ে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় অচেনা বাড়িতে প্রণাম সেরে আসা যায় স্বচ্ছন্দে। বিজয়া দশমীতে কেউ বহিরাগত নয়।
শুধু বাড়িতে নয়, দশমীর সকালে ভিয়েন বসত বারোয়ারি পুজোর মন্ডপ চত্বরেও। তৈরী হত বোঁদে, মিহিদানা, পান্তুয়া। কোথাও কোথাও আবার লুচি আলুর দম। প্রতিমা বিসর্জন করে এসে মন্ডপ ঘিরেই বিজয়া সম্মেলন। পুজোর ‘ভলেন্টিয়ার’দের জন্য। অনেকেই আবার সেই ভিয়েনের মিষ্টি কিনে নিয়ে যেত বাড়িতে। সন্ধেবেলার উৎসবের জন্য। এদিন কারও মন খারাপ নেই। ঝগড়া-ঝাঁটি, মালিন্যের কষা স্বাদ হারিয়ে যেত মিষ্টি স্বাদের তুফানে। দ্বিধাহীন ভেসে যাওয়া। দূরদেশী আত্মীয়ের জন্য মনখারাপ।
লাল কালিতে কলাপাতায় ‘১০৮ দুর্গানাম’ লেখার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ত নতুন কেনা এনভেলাপ। হলুদ পোস্টকার্ডে ‘বিজয়ার প্রীতি শুভেচ্ছা ও ভালবাসা, বড়দের প্রণাম’
আসমানী ইনল্যান্ডে দূরান্তের খবর। এবছর আর আসা হল না, পত্র দ্বারাই বিজয়ার প্রণাম সারা। সম্বৎসরের না আসায় অভিমান জমত। সে সব তুলে রাখা হত পরের বিজয়ার জন্য। বিষাদ থেকে আনন্দ যাত্রায়।