বিধান সরণী- ঐতিহাসিক কলকাতার সাক্ষী

সরকারী ব্যয়ে নয়, কলকাতা লটারি কমিটির সংগৃহীত অর্থে তৈরি হয়েছিল কলকাতার এক ব্যস্ত রাস্তা আর তার সংলগ্ন একটি উদ্যান। রাস্তাটির নাম কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট আর উদ্যানটির নাম কর্ণওয়ালিস স্কোয়ার। এই নামে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? তাহলে বলি, রাস্তাটির এখনকার নাম বিধান সরণী আর উদ্যানটির নাম আজাদ হিন্দ বাগ, যার ডাকনাম হেদুয়া পার্ক

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের গর্ভনর জেনারেল চার্লস কর্ণওয়ালিসের নামানুসারে এই রাস্তার নাম হয় কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট। স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রথিতযশা চিকিৎসক ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়ের স্মরণার্থে রাস্তাটির নাম বদল করে নতুন নামকরণ হয়।পূর্বের কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট হয়ে যায় আজকের বিধান সরণী।

কলেজস্ট্রীট ক্রসিং অর্থাৎ মেছুয়াবাজার(বর্ণপরিচয় মার্কেট) থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাস্তার দুধারে ইতিহাসও যেন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে। একটু কান পাতলেই শোনা যায় সেই ইতিহাসের কথা বলার ফিসফিস শব্দ। কত যুগের কত ঘটনার সাক্ষী এই রাজপথ; এই পথের ধূলোয় মিশে আছে শ্রীরামকৃষ্ণ, বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, নেতাজী প্রমুখ আরও কত জ্ঞানীগুণী মানুষের পদধূলি।

কলেজস্ট্রীট থেকে রওনা দিয়ে শ্যামবাজারের দিকে এগোতে থাকলে হাতের বাঁ দিকে পড়বে তিনশো বছরেরও বেশী পুরোনো ঠনঠনিয়া কালীমন্দির। উদয়নারায়ণ নামে এক জনৈক শাক্ত ব্রহ্মচারী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তিনিই ছিলেন এই মন্দিরের পূজারী, তারপর পূজার ভার গ্রহণ করেন হালদার বংশীয় এক পুরোহিত। তারও পরবর্তী কালে ১১১০ বঙ্গাব্দে শঙ্কর ঘোষ নামে এক ব্যক্তি বর্তমান এই মন্দির ও দেবীমূর্তি নির্মান করিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে এসেছিলেন। ডাকাতের উপদ্রব থেকে এলাকাবাসীকে সতর্ক করতে এই মন্দিরে ছিল এক বিশাল ঘন্টা। সেই বিশাল ঘন্টার ঠনঠন আওয়াজ থেকেই এই অঞ্চল এবং কালীবাড়ির নাম হয় ঠনঠনিয়া।

ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি থেকে আরও একটু এগোলেই রাস্তার একই দিকে পড়বে সিমলা পাড়ার সেই বিখ্যাত দত্ত বাড়ি, যেখানে ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে জন্ম নিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বর্তমানে যেটা Ramakrishna Mission Swami Vivekananda's Ancestral House and Cultural Centre. ১৯৯৯ সালে রামকৃষ্ণ মিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহায়তায় এই বাড়ি ও তৎসংলগ্ন জমি অধিগ্রহণ করে। যথাযথ সংস্কারের পর ২০০৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে স্বামীজির স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ির দ্বার মিউজিয়াম ও কালচারাল সেন্টার রূপে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

রাস্তার উল্টোদিকেই ঐতিহাসিক বইয়ের দোকান ডি.এম.লাইব্রেরি, আর সামান্য একটু এগিয়েই বিখ্যাত চাচার কাটলেটের দোকান, (যদিও এই দোকান সম্প্রতি নাম লিখিয়েছে ইতিহাসের পাতায়)। এইদিকের ফুটপাত ধরেই আর একটু এগোলেই সেই বিখ্যাত হেদুয়া পার্ক, যার পোষাকি নাম- আজাদ হিন্দ বাগ। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে বিধান সরণীর মত এই রাস্তাও তৈরি হয়েছিল লটারির মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থে আর এই পা্র্কের নামও ছিল লর্ড কর্ণওয়ালিসের নামে। ব্রিটিশ শাসনকালে কত বিপ্লবের সাক্ষী এই হেদুয়া পার্ক, তরুণ নরেন্দ্রনাথ ও এসেছেন এই হেদুয়ায়। ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের কাছে আজও ভীষণ প্রিয় এই পার্ক।বিশেষত সাঁতারের জন্য হেদুয়া সর্বজনবিদিত।

হেদুয়া পার্কের উল্টোদিকেই সগৌরবে অবস্হান করছে নারীশিক্ষার অগ্রদূত বেথুন কলেজিয়েট স্কুল। সুকিয়া স্ট্রীটে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে মাত্র নয় ছাত্রী নিয়ে শুরু হওয়া ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল এর ই পল্লবিত রূপ বিধান সরণীর এই বেথুন স্কুল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিদ্যোৎসাহী মানুষের সহযোগিতায় জন এলিয়েট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সমাজের কুসংস্কারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জ্বালিয়ে দেন নারীশিক্ষার প্রদীপ। সেই প্রদীপ থেকে ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলায় দীপাবলির আলোর মত উজ্জ্বল হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো আরও অনেক বালিকা বিদ্যালয়। বাঙালী মেয়েরা জ্বালিয়ে তুললো জ্ঞানের মশাল। বেথুন স্কুলের কৃতী ছাত্রীদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম দুজন মহিলা গ্রাজুয়েটের মধ্যে একজন ও ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতিতে শিক্ষিত প্রথম দক্ষিণ এশীয় মহিলা ডাক্তার), চন্দ্রমুখী বসু(অপর প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট ও পরবর্তী কালে বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা), ডক্টরেট অসীমা চট্টোপাধ্যায় (বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করা প্রথম ভারতীয় মহিলা), স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ।ঐতিহ্যের পথ ধরে মেয়েদের আপন ভাগ্য জয় করার অধিকারের লড়াইয়ে আজও সামিল এই বিদ্যালয়।

১৩ সংখ্যাটি অপয়ার তকমা পেলেও ১৩/এ কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের বাড়িটা Unlucky 13 প্রবাদটিকে মিথ্যে প্রমাণিত করেছে। ১৮৫৯ সালে এই বাড়ি থেকেই পথ চলা শুরু হয় Calcutta Training School এর। পরবর্তী কালে এই বাড়িতেই সপরিবারে বসবাস করতে থাকেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জেষ্ঠ্যা কন্যা বিধুমুখীর বিয়ে হয় প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে, বিয়ের পর তিনিও বেশ কিছুদিন বাস করেন এইবাড়িতে। এখানেই জন্ম হয় উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখীর জেষ্ঠ্যপুত্র -স্বনামধন্য শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের। তাছাড়াও এই বাড়িতেই প্রথম সূচনা হয় ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়-এর। ব্রাহ্ম সমাজ পরিচালনার বিভিন্ন কাজের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল দ্বারকানাথ ও এই বাড়ির নাম। তবে, দুঃখের বিষয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ বাড়িটি জরাজীর্ণ, যেকোনো দিন হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঐতিহ্যের গন্ধ মাখা এই ঐতিহাসিক বাড়িটা।

এই পথ ধরে চলতে চলতেই চোখে পড়বে ভারতীয়দের অর্থে চলা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতি বিজড়িত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটশন- আজকের বিদ্যাসাগর কলেজ। কিছুটা দূরেই অবস্থিত স্কটিশ চার্চ কলেজ। প্রেসিডেন্সি কলেজের ভারতবিদ্বেষী অধ্যাপক ওটেন সাহেবকে মারার অপরাধে সুভাষচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত করার পর, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সুভাষচন্দ্রকে এই কলেজেই পড়ার ব্যবস্হা করে দেন। সুনাম নিয়ে আজও শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজ করছে স্কটিশ চার্চ কলেজ।

বিধান সরণীর বুকে অবস্থিত আরও একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হাতিবাগানের গস্টার থিয়েটার। প্রবঞ্চিতা নটী বিনোদিনীর কান্না বুকে নিয়ে স্টার থিয়েটারের পথ চলা শুরু হয় বিডন স্ট্রীটে, পরবর্তী কালে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে স্হানান্তরিত হয় এই প্রেক্ষাগৃহ। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ অনেক অভিনেতা অভিনেত্রীদের বিভিন্ন চরিত্র হয়ে ওঠার সাক্ষী এই থিয়েটার। ১৯৯১ সালে এক রাতে হঠাৎ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয় স্টার থিয়েটার। এই ঘটনার প্রায় ১৩ বছর পর, ২০০৪ সালে ঐতিহ্য কে সঙ্গী করেই নতুন অবয়বে আবার আত্মপ্রকাশ করে স্টার থিয়েটার। অবশ্য এখন স্টার থিয়েটার মানুষের কাছে বেশী পরিচিত সিনেমা হল হিসাবেই।

সংস্কৃতিপ্রেমী ও বিনোদনমুখী কলকাতাবাসী বাঙালির কাছে হাতিবাগান একসময় ছিল সিনেমাপাড়া।মিনার,দর্পনা,মিত্রা,রূপবাণী এই হল গুলো শুধু হল ছিল না, ছিল বাঙালির আবেগের এক একটা টুকরো‌। কালের নিয়মে আজ বেশীরভাগ হলই রূপান্তরিত হয়েছে বহুতল বা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং মলে।তবে ফুটপাত জুড়ে হরেক জিনিসের পসরা আর দরদাম করে সেসব কেনা বেচা পথ চলতে অসুবিধার কারণে হলেও,একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে,চলার পথে কেনাবেচার এই হাঁকডাক গুলোই চালু রেখেছে শহরের হৃদস্পন্দন কে‌।

হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়ে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়। বাকী চারদিকের রাস্তার মতোই বিধান সরণীও মিশে যায় অশ্বারোহী নেতাজীর মূর্তির সামনে। আর আমাদেরও শেষ করতে হয় এক ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা।

নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...