ভূপেন যখন বিএ পড়ছেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখনই তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাইটির জন্ম হল!
ভূপেন সব থেকে বড়। তাঁর পরে একে একে এই নিয়ে মোট ন'টি সন্তানের জন্ম দিলেন বাবা!
বাড়িতে তেমন সচ্ছলতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনে দেওয়াটাও যেখানে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; সেই অবস্থাতেও বাবা কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে জন্ম দিচ্ছেন একের পর এক ভাইবোনের! ব্যাপারটা আর সহ্য হল না ভূপেনের।
ফলে, সবচেয়ে ছোটটির জন্মের খবর পেয়েই বেনারস থেকে বাড়ি এলেন তিনি। এসেই কঠিন কণ্ঠে বাবাকে বললেন, বয়সের কথা যদি না-ও ভাবেন, সংসারের অবস্থার কথাটা ভেবে এবার অন্তত আপনার থামা উচিত!
কিন্তু ছেলের এই উপদেশ বাবার মোটেই পছন্দ হল না। আর সেটা বুঝিয়ে দিতেই ছেলের গালে তিনি সপাটে একখানা চড় কষালেন!
পরিণতিটা সেকালের সিনেমার মতো হল না, হল একালের সিনেমার মতো। বাবার হাতে চড় খেয়ে একঘেঁয়ে চরিত্রের ছেলেপুলের মতো ভূপেন ঘর ছাড়লেন না। উল্টে শুরু করলেন গান্ধীগিরি। ভাইবোনদের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বাবার চোখের সামনে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে লাগলেন।
এতে একটা জিনিস হল, ভূপেনের দশ নম্বর ভাই বা বোনটির জন্ম দিতে বাবা আর সাহস করলেন না!
বাবা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলেও হৃদয়হীন ছিলেন না। গান রচনার প্রতি তাঁর যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল, সঙ্গীতের প্রতি দারুণ অনুরাগ ছিল। এই দুটো গুণই ভূপেন বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে শৈশব থেকেই বাবা যত্ন করে তাঁকে ওস্তাদজির কাছে গান শিখিয়েছেন।
তবে, লোকসঙ্গীত আর লোকসুরের প্রতি ভূপেনের যে অনুরাগ, তা কিন্তু জন্মসূত্রেই তিনি অর্জন করেছিলেন। শৈশবেই তার লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। কীভাবে? তা-ই নিয়ে একটা গল্প আছে। সেটাই এখন বলছি:
ভূপেন সবে হাঁটতে শিখেছেন, কিন্তু তখনও অব্দি মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়েননি। এরকম একটা বয়সে হাঁটি হাঁটি পা পা করে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে গাঁইগুষ্টির চোখ এড়িয়ে কোথায় একদিন হারিয়ে গেলেন!
সকলের যখন খেয়াল হল, তখন ঘরে-পাঁদাড়ে খোঁজ শুরু হল; সেখানে না-পেতেই হুলুস্থুল অবস্থা! মা ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারাতে লাগলেন, বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন, বাকিরা হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল। কিন্তু সারারাত খুঁজেও সেই রত্তি ছেলেকে কোথাও পাওয়া গেল না...
সকাল হল। তখন কয়েকজন আদিবাসী এয়ো ভূপেনকে কোলে করে নিয়ে এসে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিলেন। হারানো ধন ফিরে পেয়ে মা যেন প্রাণ পেলেন প্রাণে!
তখন সকলের মনে প্রশ্ন জাগল যে, আঁতিপাঁতি খুঁজে যাকে পাওয়া গেল না, সেই ভূপেনকে আদিবাসী নারীরা পেলেন কোথায়?
আদিবাসী নারীরা জানাল যে, আঁধার নামার সময় দেওঠাকুরটির মতন হেঁটে-হামাগুড়ি দিয়ে ভূপেন তাদের পাড়ায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। অমন সুন্দরপানা খোকাকে পেয়ে তারা বুকে তুলে নিয়েছিল। তারপর যখন খোকা আপনা থেকেই তাদের বুকের দুধ খেতে শুরু করল, তখন আর কোল থেকে নামাতে ইচ্ছে করল না।
তারপর তো আঁধার হল। শুরু হল নাচগান। আদিবাসী লোকগান। সে গান শুনে খোকার সে কী আনন্দ! সারারাত চলল নাচগান। খোকা সারারাত এই মায়েদের বুকের দুধ খেল, আর গানের তালে হাতপা ছুঁড়ে কত্ত আনন্দ করল। এই সক্কাল সক্কাল খোঁজাখুঁজির খবর শুনে খোকাকে তার মায়ের কোলে দিতে এসেছে!
সব শুনে সকলেই তাদের অবিবেচনার জন্য খুব বকাবকি করতে লাগলেন। তখন সেই আদিবাসী মায়েরা মাথা চুলকে সরল হেসে বলল, তাই তো গো, গান শুনে খোকা খুব আনন্দ পাচ্ছিল তো, তাই দেখে এত ভালো লাগছিল যে, তোমাদের কথা ভাবাই হয়নি...ইস, দেখ দেখি কী কাণ্ড!
আর কিছু বলে লাভ নেই ভেবে, এ-কথার পর আর কেউ কথা বাড়ালেন না!
তবে এ-ঘটনা থেকে বাবা বুঝলেন যে, ছেলের হবে। তাই পাঁচ বছর বয়স হতে-না হতেই ছেলেকে ওস্তাদজির আসরে ভর্তি করে দিলেন।
ছেলেও তেমনি, অল্পদিনেই প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করলেন। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই প্রথম সুর দিয়ে বসলেন গানে। বাবার লেখা গান। তাতে বসালেন আজন্মের আকর্ষণ, লোকগানের সুর। অহমীয়া লোকগান।
তারপর ১৯৩৫-এ এসে মাত্র এগারো বছর বয়সে প্লেব্যাক সিঙ্গারও হয়ে উঠলেন ভূপেন। যে-ছবির জন্য তিনি গান গাইলেন, সেই ছবির নাম, 'জয়মতী'। এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল তাঁর বর্ণময় সঙ্গীতজীবনের জয়যাত্রা।
সুরকার হিসেবে ভূপেনের প্রথম হিন্দি ছবি 'আরোপ' (১৯৭৩)। এই ছবির 'নেয়নোঁ মে দরপণ হ্যায়' খুবই বিখ্যাত গান। কিশোর কুমার ও লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েট।
গানটির সুর লোকগানের সুর থেকে নেওয়া। সেই লোকসুর তিনি পেয়েছিলেন শিলং-এ বেড়াতে গিয়ে। এক খাসি রাখাল গুন গুন করে সুর ভাঁজছিল, সেই সুর তাঁর এত ভালো লেগে গেল যে, তাই দিয়েই বানিয়ে ফেললেন তাঁর প্রথম সর্ব-ভারতীয় ছবির গান। এবং, গানটি শুধু বানালেনই না, তাই দিয়ে মাতিয়ে দিলেন আপামর শ্রোতাদের।
শুধু আদিবাসী, শুধু অহমীয়া, শুধু খাসি লোকগান নয়; সারা পৃথিবীর লোকগান তাঁকে আকৃষ্ট করত। আমেরিকার নিগ্রো লোকগানের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ছিল। পল রোবসনের গানে যে জনজাগরণের আহ্বান আছে তার উদ্দীপনায়, অনুপ্রেরণায় ও সুরে অনেক অসাধারণ-অনবদ্য গান তিনি তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে 'বিস্তীর্ণ দু'পারে' একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ফলত ভূপেনের গানে পাওয়া যায় একই সঙ্গে সমগ্র পৃথিবীর মাটির সুর। মাটির মানুষের আত্মা। প্রান্তিক মানুষের জয়গাথা। তাই তিনি প্রাদেশিক হয়েও সর্বজনীন। মানবমুখী এই গুণপণার জন্যই 'নজরুলগীতি', 'রবীন্দ্র সঙ্গীত'-এর মতো ভূপেন হাজারিকার গানও আজ স্বতন্ত্র ঐতিহ্য নির্মাণ করে পরিচিতি হয়েছে 'ভূপেন্দ্র সঙ্গীত' নামে।