গা ছমছম করা অন্ধকার রাত। আঁধার চিরে টুপ টুপ শব্দ। সেই শব্দে তড়াক করে ওঠে এক যুবক। এগিয়ে গিয়ে দেখে তারই মতো একজন ঢোল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলে। তার ঢোলের ওপর জল পড়ে সেই আঁধার রাতে তৈরি হয়েছে এক গা হিম করা পরিবেশ। তার মধ্যেই চার চোখের বিনিময় এবং তারপরই শুরু হয়ে যায় আলোর ছটায় জঙ্গলের মধ্যে তেনাদের নেত্য। রোগা, মোটা, বেঁটে, লম্বা, সিপাই, জমিদার, রাজা কত রকমের যে ভুত! তারা দলে দলে এসে বিভিন্ন রকমের নাচ দেখিয়ে যায়।
প্রাথমিকভাবে গুপি-বাঘা ভয় পেলেও ভুতের রাজা তাদের আশ্বস্ত করেন এবং তাদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে বর দেন। তবে সবার ভাগ্য তো গুপি গাইন আর বাঘা বাইনের মতো নয়, যে বর পাবে। বেশিরভাগ ভুতই ভয় দেখায় আর আমরা ভয় পাই। আঁধার, পোড়ো আর ভাঙা বাড়ি মানেই তেনাদের রাজত্ব। কতরকমের যে ভুত হয়! পেত্নী, শাকচুন্নি, মেছো, গেছো, মামদো গুনে শেষ করা যাবে না! শোনা যায় তাঁরা নাকি বিশেষ দিনে মর্ত্যে নেমে আসেন। বিদেশে ভুতের দিন 'হ্যালোউইন' বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও আমাদের এখানে ভূতচতুর্দশী সেভাবে এখনো জনপ্রিয়তা পায় নি।
ভূত অর্থাৎ অতীত। এই অতীতকেই স্মরণ করা হয় ভূতচতুর্দশীর মাধ্যমে। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে এদিন নাকি মৃত পূর্বপুরুষরা মর্ত্যে আসেন। তাঁদের খুশি করতে এবং অতৃপ্ত আত্মাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতেই ভূতচর্তুদশী পালন করা হয়। দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন এই চতুর্দশী পালন করা হয়। এই দিন চোদ্দ শাক খাওয়া ও চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে।
হিন্দুদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। অর্থাৎ আকাশ, মাটি, জল, হাওয়া আর অগ্নি প্রকৃতির এই পাঁচ উপাদানের মধ্যেই মিশে থাকেন পূর্বপুরুষ। তাই প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা চোদ্দ রকমের শাক মৃত চোদ্দ পুরুষের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করা হয়। জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, ওল, পুঁই, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষনি মূলত এই চোদ্দ রকমের শাক রান্না করা হয়। চোদ্দ শাক ধুয়ে সেই জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় বাড়ির প্রতিটি কোণে। একই সঙ্গে প্রেত ও অশুভ শক্তি দূর করতে এই দিন সন্ধ্যায় চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর রেওয়াজ রয়েছে।
পুরাণ অনুসারে ভূতচতুর্দশী নিয়ে একটি কাহিনি শোনা যায়। দানব রাজা বলি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করার পর পরই নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড শুরু করেন। সেই আক্রোশ থেকে স্বর্গের দেবতারাও রেহাই পান না। বলির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় দেবগুরু বৃহস্পতি দেবতা বিষ্ণুকে জানান। এরপর বামনের ছদ্মবেশে দেবতা বিষ্ণু বলির রাজসভায় উপস্থিত হন। রাজা বলির কাছে তিন পা সমান জমি ভিক্ষা চান। রাজা বলি দেবতা বিষ্ণুর ছদ্মবেশ বুঝতে পারেন। তারপরও তিনি ভিক্ষা দিতে রাজি হয়ে যান।
বামনের ছদ্মবেশে দেবতা বিষ্ণু দু-পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করে নেন। নাভি থেকে বেরিয়ে আসা তৃতীয় পা রাখেন স্বয়ং রাজা বলির মাথায়। বিষ্ণুর পাদ স্পর্শে পাতালে নেমে যান বলি। সেই থেকে পাতালে বলি রাজার বাস। তবে সব জানা সত্ত্বেও রাজা বলি ভিক্ষা দিতে রাজি হওয়ার জন্য দেবতা বিষ্ণু করুণা বশতঃ তাঁকে আশীর্বাদ করেন। প্রতি বছর মর্ত্যে বলি রাজার পুজো হবে। মনে করা হয় সেই থেকে কালী পুজোর আগের রাতে বলি রাজা পাতাল থেকে পুজো নিতে মর্ত্যে উঠে আসেন। তাঁর সহচর হিসেবে থাকে শত সহস্র ভুত ও অশরীরী।
পঞ্জিকা মতে আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিতে কালীপুজো বা দীপাবলির আগের দিন চোদ্দ শাক খাওয়া ও চোদ্দ প্রদীপ চোদ্দ পুরুষের উদ্দেশ্য জ্বালানো হয়। কালীপুজোর সঙ্গে এর কতটা যোগাযোগ আছে সে বিষয়ে বিশেষভাবে জানা যায় না। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে হৈমন্তির ফসলকে কীটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অনেকগুলো প্রদীপ জ্বালিয়ে এই উপাচার্য পালন করা হত। এছাড়া ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে এই শাকগুলো খাওয়া হয়ে থাকে। বাংলায় ঋতু পরিবর্তনের প্রকোপ অন্য প্রদেশ থেকে বেশি হওয়ায় আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাসে এই রীতি পালন করা হয় যা আজও বহমান।