ভূতবাবা; দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক বিশিষ্ট লৌকিক দেবতা

বাংলায় যে কত বিচিত্র ধরণের লৌকিক দেবতা আছেন তা গুণে শেষ করা যায় না। ভূতের দেবতা ভূতবাবাও পুজো পাচ্ছেন এই বঙ্গে, ভূত প্রেতও বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। ভূতচতুর্দশী আমাদের উৎসবেরই অঙ্গ, যা যুগ যুগ ধরে দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের রাতে পালিত হয়। কিছু লৌকিক উৎসবে ভূতের আলপনা আঁকা হয়। ভূতের পালকি চড়ে ভূত দম্পতি তাদের উত্তরপুরুষের তিনি আসে। ভূত শব্দটি দিয়ে মহাদেবের প্রচুর নাম পাওয়া যায়। যেমন – ভূতনাথ, ভূতেশ, ভূতপতি, ভূতেশ্বর ইত্যাদি, তাই বলাই যায় ভূতবাবা আদপে মহাদেবেরই অংশ। অন্যদিকে পৃথিবীর পঞ্চভূত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুত্‍ ও ব্যোম। এই মহা পঞ্চভূত নিয়ে জীবদেহে গঠিত। এর অধিপতি কিন্তু ভূতনাথ অর্থাত্‍ স্বয়ং মহাদেব।
 
আজ আমরা ভূতবাবার পুজো নিয়ে কথা বলব। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক বিশিষ্ট লোকদেবতা হলেন ভূতবাবা বা ভূতেশ্বরবাবা। আদিগঙ্গার তীরে শুলিপোতা কৃষ্ণমোহন রেলস্টেশন নিকটে রেলগেটের কাছে ভূতবাবা থানটি অবস্থিত। এই অঞ্চলের লোকেরা এই থানকে ছোটকাছারী বলে ডাকেন। ভূতবাবার আরেকটি থান রয়েছে। সেটি বিষ্ণুপুরে থানার অন্তর্গত ঝিকুরবেড়িয়া গ্রামে। সেটি ভক্তদের কাছে বড়কাছারী নামে পরিচিত। দুই থানই পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত।
 
স্থানীয়দের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে যে, অতীতে বিষ্ণুপুরের বড়কাছারী নিকট যেতে হলে অনেক রাস্তা হাঁটতে হত। এছাড়া ভক্তদের মানত পূরণ করতে অনেকটা পথ চলতে হত। সেই কারণে অতীতে কোন এক ভক্ত এই থানটি তৈরী করে দেন। ছোটকাছারী নাম দিয়ে পূজা শুরু হয়। সেই থেকে ভূতবাবা-র থানটি ছোটকাছারী নামে পরিচিত। বলাইবাহুল্য এই থানটি নবীন। মন্দিরের লোকেদের কাছে জানা যায় যে, বর্তমানে ভূতবাবার পাকা ইটের তৈরী মন্দির যেটি দেখা যায়, সেটিও এক ভক্ত চাকরি লাভ করার ফলে নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
 
কিন্তু আদিতে কোন মূর্তি বা দেবতার মূর্তি ছিল না। এখন ভূতবাবার যে মূর্তিটি রয়েছে তা মর্মর মূর্তি, মৃত্তিকা নির্মিত। এই মূর্তিটি গঠনশৈলী পরিকল্পনা কার এবং কোথা থেকে তা সংগৃহীত সে বিষয় কিছুই জানা যায় না।
 
ভূতবাবা সিংহাসনের উপর বামপদ ঝুলিয়ে বসে আছেন। দক্ষিণপদ বাম জানু উপর উপবিষ্ট। হাতে গলায় রুদ্রাক্ষ দেখা যায়। বিস্তৃত মোটা গোঁফ। দেবতার দুই হাত। এক হাতে গাঁজার কলকে। মাথায় চুল ও সৌম্যমুখ। ভূতবাবার ডানদিকে সহচর, বামদিকে নৃত্যরত আরেক সহচরী চোখে পড়ে। কেউ কেউ বলেন ভূতবাবার মূর্তিটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতে পূজিত ধর্মঠাকুরের মূর্তির সাথে মিল আছে। আবার বাবা পঞ্চানন্দঠাকুরের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্য দেখা যায়। আদপে প্রত্যেকেই শিব। বাংলার লৌকিক শিব কৃষিজীবী, তারও গোঁফ রয়েছে; আদপে শিব এইভাবেই সাধারণের মধ্যে মিশে গিয়েছেন।
 
অতীতে এখানে কোন মূর্তি পুজো হত না। আদিতে এখানে একটি শ্যাওড়া গাছকেই ভূতবাবার প্রতীক হিসাবে পুজো করা হত। স্থানীয় ভাষায় এই গাছকে বলে 'দুধে–আশ–শ্যাওড়া'। মন্দির প্রাঙ্গনের অতি প্রাচীন ও রহস্যময় শেওড়া গাছ, এখনও সেই গাছটি দেখা যায়, যা মন্দিরের সামনের দিকে রয়েছে। বহু ভক্তগণ এই গাছের গোড়ায় মাটি ও শিকড় ঔষধ রূপে ব্যবহার করে। মেলার সময় এইগাছের শিকড় তুলে বাচ্চাদের মাদুলি দেওয়া হয়। ভক্তদের বিশ্বাস এই মাদুলি পরলে শিশুদের ভয় ও রোগ নিরাময় হয়ে যাবে।
 
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বড়কাছারি বা ভূত কাছারি মন্দিরও খুবই প্রসিদ্ধ। বহু বছর ধরে এখানে মহাদেব পূজিত হয়ে আসছেন। কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবারগামী রাস্তায় আমতলা থেকে বিবিরহাটের দিকে রাস্তায় পরবে এই মন্দির। একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছকে ঘিরে অধূনা মন্দির। পাশে তারকেশ্বরের মতো দূধপুকুর। শনি ও মঙ্গলবার ভক্তসমাগম হয়, মূলত সন্তান লাভের আশায় এখানে মানত করা হয়। মানত পূরণ হলে গোপাল ঠাকুরের মূর্তি দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের মতো অসংখ্যা গোপাল ঠাকুরের মূর্তি দেখা যায়। খুবই জাগ্রত দেবতা বলে ভূত বাবার প্রচার রয়েছে, অসংখ্য লোককথা প্রচলিত আছে। অসংখ্য ভক্ত  মন্দির সংলগ্ন দূধপুকুরে স্নান করে দন্ডি কাটে তারপর বস্তা বস্তা বাতাসা লুট দেওয়া হয়, বাচ্চাদের ওজনের বাতাসা পুজোর পর বিতরন করা হয়। 
 
ভূতবাবার বাত্‍সরিক পুজো হয় ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষে যেকোন শনিবার ধরে। সেই দিন এখানে মেলা বসে। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার ১২ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত বিশেষ পুজো হয়। বহু মানুষ আসেন এই মন্দিরের এবং তাদের মনোস্কামনা জানান ভূতবাবাকে। বর্তমানে পুরোহিত পুজো করলেও আগে কিন্তু কোন পুরোহিত এই দেবতার পুজো করতেন না। বাবার পুজোয় বৈচিত্র্য দেখা যায়। বাবার পুজোর উপকরণে থাকে শোলমাছ , মদ, গাঁজা, সিদ্ধি, বাতাসা ও ফলমূল। অনেকে ভূতবাবার শ্যাওড়া গাছতলায় মদ, গাঁজা শোলমাছ দিয়ে পুজো দেন। এই থেকে বোঝা যার ভূতবাবা শ্যাওড়া গাছের প্রতীক। ধপধপি দক্ষিণেশ্বরে জাঁতাল পুজোর দিনে মদ গাঁজা শোলমাছ নিবেদন করা হয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় অন্যান্য লোক দেবদেবীর সঙ্গে কিছু না কিছু মিল আছে।
 
ভারতের এমন কিছু মন্দির রয়েছে যেখানে দেবতার স্থানে অশরীরীদের ভিড় থাকে। আসুন তেমন কিছু ভূতের মন্দিরের কিসসা জানি... মহেন্দিপুর বালাজি মন্দির, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই মন্দিরে পুজো দিতে আসে। এর পিছনে একটাই উদ্দেশ্য। এখানে পুজো দিলে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে। ঈশ্বর প্রসন্ন হন।
 
এই কারণেই ভক্তরা একটি কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন। মন্দিরের দেওয়ালের সঙ্গে নিজেকে চেন দিয়ে বেধে গায়ে গরম জল ঢেলে দেন আর তাতেই সব পাপ মুক্তি ঘটে। এমনই কষ্টদায়ক উপায়ে পাপমুক্তি ঘটাতে মরিয়া সমস্ত ভক্তরা। শুধু তাই নয়, এটিই দেশের একমাত্র মন্দির যেখানে অশরীরী আত্মা তাড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। তাই স্থানীয়দের অনেকেই বলেন এই মন্দিরে শয়তানের বাস রয়েছে।
 
শ্রী কষ্টভঞ্জনদেব হনুমানজি মন্দির, বজরংবলির পুজো দিতে ও অশুভ আত্মা তাড়াতে গুজরাটের এই মন্দিরে ভক্তরা ভিড় করেন। স্থানীয়দের একাংশ মনে করেন রাত হতেই মন্দিরে নাকি অশুভ আত্মা ঘুরে বেড়ায়। এমনকী অনেকেরই ক্ষতি করেছে তারা। 
 
দেবজি মহারাজ মন্দির, এই মন্দিরে পা রাখা মাত্রই অদ্ভুত কিছু ঘটনার সাক্ষী হতে পারেন। যা সচরাচর মন্দিরের ভিতরে দেখা যায় না। প্রতি পূর্ণিমাতে ঝাড়ু মেরে যেমন ভুত তাড়ানো রয়েছে, তেমন মন্দির চত্বরে প্রতিবছর ভূত মেলার আয়োজন করা হয়। সবমিলিয়ে ঈশ্বরের স্থানে সারা বছরই গা ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করে।
 
দত্তাত্রেয় মন্দির, অমাবস্যা কেটে গেলেই মধ্যপ্রদেশের বেতুল জেলায় অবস্থিত এই মন্দিরটিতে ভিড় জমে। সকাল ১১ টার সময় মহামঙ্গল আরতি শুরু হয়। কিন্তু আরতির চমক হল, সেখানে ঈশ্বর বন্দনার বদলে ভগবানকে তিরস্কার, ভৎসনা করা হয়। কারণ মানুষের বিশ্বাস তাদের মধ্যেই শয়তান লুকিয়ে রয়েছে। এমনকী মন্দিরের দেওয়াল, ঘন্টার উপরেও অনেককে অদ্ভুত ভাবে বসে থাকতে দেখা যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...