ব্যালকনি বা ছাদে শেড ছাড়া এই বর্ষায় ভিনকা-নয়নতারা বাঁচাবেন কীভাবে?

ছোট্ট একটা বাগান করার শখ আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত উঠোন নেই। বহুতল ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, ছাদ অনেক বড়; কিন্তু সেখানে টবে গাছপালা করলে হয় বাধা আসে, নয়তো অন্যেরা ফুল ও গাছ নষ্ট করে দেয়—এমন সমস্যা হয়তো সবার নয়, কিন্তু অনেককেই ফেস করতে হয়। সেক্ষেত্রে নিজের শখ পূরণের সবচেয়ে ভালো উপায় ব্যালকনি। ব্যাগড়ার ভয় নেই। এক্কেবারে নিজের জন্য নিজের মতো করে সহজেই ছোট্ট বাগান তৈরি করে নেওয়া যায়। বেশি না-হোক, ঘন্টা দুই বা তিনেকের জন্য সেখানে হালকা থেকে মাঝারি রোদ আসে তো? ব্যস, তাহলে আর চিন্তা নেই। ওতেই হয়ে যাবে আপনার সাধের বাগান।

ব্যালকনি বা ছাদ নিজের হলেও অনেকের আবার সময়ের অভাবে শখ থাকলেও বাগান করা হয়ে ওঠে না। কেননা, বিভিন্ন ধরণের ফুলের চাষ করলে তাদের পরিচর্যাও বিভিন্নভাবে করতে হয়, ফলে প্রতিটি গাছকে আলাদা করে সময় দিতে হয়। অবশ্য এই সমস্যার সমাধান আছে হাতের কাছেই। যে সব ফুলগাছের তেমন কোন যত্ন লাগে না, মাঝে-মধ্যে জল আর সামান্য খাবার দিলেই যারা ফুলে ভরিয়ে রাখে, তেমন ফুলের গাছ লাগালেই হল। এমনই একটি ফুলের গাছ হচ্ছে, ‘নয়নতারা’।

নয়নতারা সারা বছরই ফুলে ভরিয়ে রাখে তাই হিন্দিতে একে ‘সদাবাহার’ বলে। দিশি জাতের নয়নতারা সাদা, গোলাপি এই দুই রঙেই বেশি দেখা যায়। আরও দু’একটি রঙে পাওয়া যায়। এদের তেমন কোন যত্ন লাগে না। পঞ্চাশভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে পঁচিশভাগ হলদেটে মোটা বালি, পঁচিশভাগ ভার্মি কম্পোস্ট মিশিয়ে মাটি তৈরি করুন একেবারে ঝুরঝুরে করে। এই মাটি ভরে ছয় বা আট ইঞ্চি টবে চারা লাগাবেন।

টবের তলায় ফুটো থাকে, অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। কারণ, টবে জল জমে থাকলে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হয়, তাতে গোড়া পচে যে-কোন গাছ মারা যায়। তাই গাছ বা চারা লাগানোর আগে টবের তলার ফুটোটি খোলামকুচি দিয়ে আলতো ঢেকে তার ওপর কুচো পাথর দু’মুঠো মতো দিয়ে সেটা ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। পাথরের ওপর দিতে হবে মোটা বালি। বালিতে পাথর ঢেকে যাবে। এবার বালির ওপর দিতে হবে গাছ লাগানোর জন্য তৈরি করা মাটি। সেই মাটিতেই গাছের চারা বসাতে হবে। চারা বসিয়ে গাছে গোড়া ও টবের পুরো মাটিটা জলে ভেসে যায়, এমনভাবে জল দিতে হবে। 

এই যে প্রসেসটা হল। এতে গাছের গোড়ায় জল দিলে গাছ যেটুকু নেওয়ার নেবে, বাকিটা মাটি, বালি, পাথর ও খোলামকুচির ফাঁক বেয়ে বেরিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, নতুন গাছ লাগানোর পরই তার গোড়ায় জল দেবেন। তারপর টবশুদ্ধ গাছটিকে তিনদিন ছায়ায় রাখবেন। দেখবেন এই সময় গাছের গায়ে একেবারেই যেন রোদ না লাগে। চতুর্থ দিনে টবশুদ্ধ গাছটিকে বের করে হালকা রোদে রাখবেন। তার পরদিন স্বাভাবিক পরিবেশে, যেখানে তার জন্য আপনি জায়গা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, সেখানে রেখে দেবেন। শুধু নয়নতারা নয়, যে-কোন গাছ লাগানোর পরই এই নিয়ম মানলে কোন গাছই দেখবেন আপনার মরবে না। হঠাৎ করে রোদে নামিয়ে দিলে গাছের খুব ধকল হয়, সেই ধকল সহ্য করতে না-পারলে তারা মরে যায়।

গাছ লাগানোর সময় আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কথা মাথায় রাখতে হবে, সেটাও এই প্রসঙ্গে আপনাদের বলে দিইঃ

এক, যে চারা কোন পটে বা পলিব্যাগে থাকে না, সেটা বাজার থেকে কিনে এনেই লাগিয়ে দেবেন; এক্ষেত্রে কিচ্ছু করার নেই। কিন্তু চারাটি যদি পট বা পলিব্যাগে থাকে (সেরকম চারাই কেনার চেষ্টা করবেন), তাহলে এনেই সঙ্গে সঙ্গে লাগাবেন না। তাকে অন্তত দিনদশেক হালকা রোদ আসে এমন জায়গায় রেখে দেবেন। নার্সারির অভ্যস্ত আলাদা পরিবেশ ও আবহাওয়া থেকে সে এসেছে, এই সময়টুকু তাকে দিন আপনার বাড়ির পরিবেশ ও আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে। দেখবেন, তারপর চারা যখন টবে লাগাবেন, তখন চারা আর মরবে না। মানুষের যেমন চেনা পরিবেশ থেকে অচেনা পরিবেশে গেলে মানিয়ে নিতে সময় লাগে, গাছেরও ব্যাপারটা কিন্তু তেমনই। আসলে, এই সময়টুকু অনেকেই দেন না বলে তাঁদের লাগানো চারা অনেক সময়ই ধকল সহ্য করতে না-পেরে মারা যায়।

দুই, গাছ লাগানোর পর নিজের মর্জি মতো জল একেবারেই দেবেন না। যদি দেখেন টবের মাটি শুকিয়ে এসেছে, তখনই জল দেবেন, নচেৎ নয়। মাটি কাদা কাদা হয়ে থাকলে গাছের খুব ক্ষতি হয়। শিকড় পচে মরে যায়। পুরসভার জলে ক্লোরিন থাকে, সেই জল টাটকা গাছে দিলে অনেক গাছেরই ক্ষতি হয়। তাই সেটা চব্বিশ ঘন্টা কোন পাত্রে ধরে রেখে তারপর গাছে দিলে আর ভয় থাকে না।

বলছিলাম নয়নতারার কথা; হ্যাঁ, দিশি নয়নতারা আপনারা ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে নির্দ্বিধায় লাগিয়ে ফেলুন। ফুলে ফুলে সারাটা বছর আপনাকে ভরিয়ে রাখবে। শীতের কুয়াশা-ঠাণ্ডা, গ্রীষ্মের রোদের পোড়ানি, বর্ষার অঝোরধারা—কিছুতেই এর কিছু যায় আসে না। মাটি শুকোলে জল দিয়ে গেলেই সে আপন ছন্দে ফুল ফুটিয়ে যায়। দিশি প্রজাতির নয়নতারায় পোকার সমস্যা নেই, রোগ-অসুখেরও বালাই নেই।

এবার বলি তাঁদের কথা, যাঁদের হাতে গাছের যত্ন নেওয়ার মতো সামান্য সময় আছে। তাঁরাও নয়নতারা করুন, তবে হাইব্রিড বিদেশি জাতের। এদের ‘ভিনকা’ বলে। ভিনকার আট থেকে দশ রকম রঙের ভ্যারাইটি আছে, যেমনঃ লাল, সাদা, গোলাপি, হলুদ, মেটে, কালচে, বাদামি প্রভৃতি। বুঝতেই পারছেন এদের যদি আপনার ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে একবার লাগিয়ে ফেলতে পারেন, তাহলে অন্য ফুলের আর দরকারই পড়বে না। তরতাজা গাছের টকটকে ফুলে আপনার বাগান একেবারে রঙিন ঝলমলে হয়ে উঠবে। তার আভা ছড়িয়ে পড়বে আপনার মনেও। দেবে অপার প্রশান্তি। অমূল্য আনন্দ।

ভিনকার যেমন অপূর্ব কালার-ভ্যারাইটি আর অসাধারণ সৌন্দর্য আছে, তেমনি কিছু সমস্যাও আছে। ইনি বিদেশি গাছ। তাই এখানকার বৃষ্টির জল একদম সহ্য করেন না, বেশি রোদও এঁর অপছন্দ। দুই ক্ষেত্রেই ইনি গোড়া পচে ডালপালা শুকিয়ে ধীরে ধীরে মারা যান। তাই গ্রীষ্ম বা বর্ষা নয়, শীতেই একে লাগানোর উপযুক্ত সময়। টবে লাগানোর সময় সামান্য ফাঙ্গিসাইড দিয়ে লাগাবেন। ভিনকায় ফাঙ্গাসের আক্রমণ খুব হয়। তাই মাসে দু’বার ফাঙ্গিসাইড স্প্রে করলে ভালো হয়।

এবার যারা ভাবছেন যে, ও বাবা রোদে-বর্ষায় মরে যায়, এমন গাছ করব কীভাবে! চিন্তা নেই, উপায় আছে। যে উপায়ে আমি সুফল পেয়েছি, সেটাই আপনাদের সঙ্গে আজ শেয়ার করবঃ

ছাদবাগানিদের কাছে ভিনকাকে বাঁচানোর একটাই প্রচলিত কৌশল রয়েছে, সেটা হল, বর্ষার সময় তেড়ে বৃষ্টি আসতে দেখলে শেডের নীচে চালান করা, আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে তাকে খোলা ছাদে রাখা। আবার সারা গ্রীষ্মে একটু রোদ খাইয়েই প্রতিদিন শেডের নীচে ঢুকিয়ে রাখা। নাহ, এ তো সবার পোষাবে না। এ তো আর আমসত্ত্ব বা আচার রোদে দেওয়া নয়; তাই সেই ঝক্কি নিত্যদিন নিরবধি পোষানোর কথাও না। এই ভাবনা থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম যে, আমাদের এই আবহাওয়া-জলবায়ুর সঙ্গে এই বিদেশিনীকে সইয়ে নিতে হবে।

যে চারাগুলো কিনে এনেছিলাম, জানতাম যে, তারা বৃষ্টি ও রোদ সইবে না। তাই তাদের শেড আর শেডের বাইরে করে গেছি নিয়মিত। তারপর তাদের বীজ আসতেই, সেই বীজে চারা করে সইয়ে নেওয়ার জন্য টানা রোদ-বৃষ্টিতেই রাখতে শুরু করলাম। এতে আমার প্রথমবারের চারা সব নষ্ট হয়ে গেল। হাল ছাড়লাম না। দ্বিতীয়বার চারা করলাম। এবার চারাগুলোকে অল্প অল্প করে বৃষ্টির জল গায়ে নেওয়া অভ্যেস করাতে শুরু করলাম, ধীরে ধীরে সময় বাড়াতে শুরু করলাম। রোদ সহ্য করার ক্ষেত্রেও এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করলাম। দিন পনের পর দেখলাম যে, বৃষ্টি ও রোদে তাদের কোন ক্ষতি হচ্ছে না, তারা ঠিক সয়ে নিয়েছে। এখন তাদের ছানাপোনারা আমার ছাদবাগানে দিব্যি বারোমাস ফুল দিচ্ছে। কোন সমস্যা নেই।

দিশি নয়নতারা হোক বা ভিনকা মাঝেমধ্যে ডাল খুব বেয়াড়া হলে সুন্দর করে ছেঁটে দেবেন। ছাঁটা অংশ থেকে নতুন ডাল হবে, ফুল বাড়বে। ফুলের পরিমাণ ঠিক রাখতে বীজের শুঁটি হলে তা ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। বীজ পুষ্ট হতে যে পরিমাণ পুষ্টি চায়, তাতে ফুলের পুষ্টিতে ঘাটতি হয়, ফুল ছোট হয়ে যায়। এর সঙ্গে গাছকে চনমনে রাখতে ও ফুলের সাইজ ঠিক রাখতে গাছের গোড়ায় সপ্তাহে একবার খোলপচা জল বা পেঁয়াজের খোসা পচা জল জৈব সার হিসেবে দিন। পনের দিন অন্তর ভার্মি কম্পোস্ট সার দিন। ব্যস, এতেই আপনার ব্যালকনি বা ছাদবাগান বারোমাস ভরে থাকবে ভিনকা-নয়নতারার নানা রঙের মেলায়।         

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...