‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবির সেই দৃশ্যটার কথা মনে আছে?
মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ হবে। আজকের ভাষায় ‘ডার্বি’। ম্যাচ নিয়ে গোটা কলকাতা জুড়ে হইহই কান্ড। সেই উত্তেজনার ছাপ এসে পড়েছে কলকাতা শহরের একবাড়িতেও। বাড়ির বাসিন্দা দুই ঘর পরিবার। এক পরিবার ঘটি আর এক পরিবার বাঙাল।
বাড়িতে রেডিয়ো সেট একটাই। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ শুরু হতেই দু’পক্ষই টানটান টেনশন নিয়ে বসে পড়ে রেডিয়োর সামনে।
গোল দিল কারা?
ইস্টবেঙ্গল নাকি মোহনবাগান!
মাঠের লড়াই যেন শুরু হয়ে যায় রেডিয়োর সামনে। যুযুধান দুই পক্ষ। কে জিতবে ডার্বি-সেই উত্তেজনার পারদ চরমে চড়তে চড়তেই বিগড়ে যায় রেডিয়ো...
দর্শকরা বুঝে উঠতে পারে না শেষে ম্যাচের ফলাফল কী হল!
শুধু চোখে লেগে থাকে অভিনয়! ঘটিবাড়ির কর্তার ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস আর বাঙাল বাড়ির আনাড়ি ভাগ্নার ভূমিকায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এস এম প্রোডাকশনের ব্যানারে মুক্তি পেয়েছিল ছবি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প নিয়ে বাংলা রোম্যান্টিক কমেডি। প্রেম থেকে কমেডি, দেশভাগের জ্বালা সব ছিল ছবিতে। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে অক্ষয় হয়ে আছে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের হাড্ডাহাড্ডি দৃশ্য।
জান দিয়ে অভিনয় করেছিলেন সকলে। ইস্টবেঙ্গলপ্রেমীর যুবকের ভূমিকায় জান ঢেলে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ক্লাব যে তাঁর প্রাণ। তাই মনেই হয়নি যে তিনি আসলে অভিনয় করছেন! একেবারে মাঠের ভানু যেন!
মাঠে বড় ম্যাচ থাকলে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার কয়েকবছর আগেও তাঁকে এভাবেই দেখা যেত যে!
এমনিতে তিনি বেশ নিয়ম মেনে চলা মানুষ ছিলেন। সকাল ৮টায় বাড়ি থেকে বেরতেন। বারি ফিরতেন রাত ১০টায়। সকাল ১০টা থেকে ৮টে অফিস। চাকরি করতেন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোলা’য়। একেবারে ধরাবাঁধা রুটিন।
কিন্তু এই রুটিন বদলে যেত ইস্টবেঙ্গলের খেলা থাকলে। সেদিন তাঁর হাফ ডে। ২টোয় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যেতেন মাঠে। গেট ম্যানেজ করতেন মাঠে। ৪টের সময় খেলা। সেখানে তাঁর এক গুরুও থাকতেন। মাঠে নয়, তিনি থাকতেন দর্শকাসনে। সেই ফুটবল গুরুর নাম ‘শচীন বর্মন’। তিনি মাঠে আসতেন নিয়ম করে। কোনও ম্যাচ বাদ দিতেন না প্রায়। সঙ্গে থাকতেন হিমাংশু দত্ত আর মেলোডি সংস্থার মালিক সুশীলবাবু। হাফ টাইমে শচীনদেব বর্মনের চীনাবাদাম, পান, সিগারেটের আবদার মেটাতেন তিনি।
একবার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ইখেলা হচ্ছে। ডার্বি ম্যাচ নিয়ে দারুণ উত্তেজনা। ইস্টবেঙ্গল কাঁপাচ্ছে সালে, আপ্পারাওদের মতো প্লেয়াররা। সমর্থকদের ভাষায় ‘পঞ্চপান্ডব’। হঠাৎ শচীনদেব বর্মন বলে উঠলেন, “আহা-হা কী খেলা! কী সুর, কী লয়, কী ছন্দ, যেন ফৈয়াজ খাঁর ঠুংরি”। অমনি মোহনবাগান গ্যালারী থেকে আওয়াজ উঠল, “ ওওও…আর আমাদের খেলাটা বুঝি কিছু নয়!”
ছাড়বার পাত্র নন শচীন কত্তা, সঙ্গে সঙ্গে পানের রস ভিজিয়ে জবাব ফিরিয়ে দিলেন, “আপনাদেরটাও ভাল, তবে সেটা কাঠখোট্টা ধ্রুপদ, ধামার”।
শচীনদেব পাকাপাকিভাবে বোম্বে চলে যাওয়ার পরেও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ফুটবল মাঠের টান এতটুকু কমেনি। ছবির কাজের চাপ বাড়লে ছেড়ে দিয়েছিলেন ‘আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোলা’র চাকরি। সেইভাবে গেট ম্যানেজ করাও অতীত হয়ে গেল একদিন। কিন্তু মাঠের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগে এতটুকু ভাটা পড়তে দেননি।
ভেঙ্কটেশ, ধনরাজ, সুনীল ঘোষ ছিলেন তাঁর ভাল বন্ধু। বসুশ্রী হলে নিয়মিত আড্ডা বসত তাঁদের। তাঁর মতে ‘পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ’ ফুটবলার রহমৎ সামাদ। তাঁর নিজের ফেভারিট অবশ্য রহিম। সিনেমায় যখন সবে দর্শকদের মনে ধরতে শুরু করেছেননাম হচ্ছে একটু একটু করে তখন ভাড়া থাকতেন চারু এভিনিউয়ে। সেখানে বাড়ির গাড়ি বারান্দায় আড্ডা জমত। ইস্টবেঙ্গল মাঠের ধনরাজ, ভেঙ্কটেশ চলে আসতেন। ভিতরে রান্না হত। ওপার বাংলার হেঁশেলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ত আড্ডার আসরেও।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রাক্তন সেক্রেটারী সুজন বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ভানু ব্যানার্জীর বাড়ির রান্নার গপ্পো। তাঁর কথায়, ভানুদা বলত, “পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ রান্না কি জানস! লাউয়ের চোকলা দিয়ে বটি করত আমাদের মা। এর কাছে মাংস পোলাও পৃথিবীর কোন খাবার নাই”।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৫০-এ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে নির্বাচন বেশ সাড়া জাগিয়েছিল শহরে। সে সময়েও গোঁড়া ইস্টবেঙ্গলী ভানুকে দেখা গিয়েছিল ‘অ্যাকটিভ’। লাইফ মেম্বার ছিলেন। কার্ড নম্বর-২১৩।