বাঙালির উৎসবের প্রহর যেন ফুরোতেই চায় না। দুর্গাপুজো পেরোতে না পেরোতেই চলে আসে লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, দেওয়ালি আর তারপরেই ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া। এই অনুষ্ঠান বাঙালির কাছে যতটা পুরনো ঠিক ততটাই নতুন। এই সমস্ত উৎসব কোনওদিন পুরনো হয় না। সারাবছর ধরে দিদি বা বোন তার ভাই বা দাদাকে একটা মাত্র চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। ওই বিশেষ দিনটির জন্য কতই না প্রস্তুতি চলে।
রবীন্দ্রনাথ রাখীবন্ধন উৎসবের মধ্যে দিয়ে মানুষের মৈত্রী সাধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাখী তো আসলে অবাঙালিদের উৎসব। রাখীর মতো আমরা অনেক উৎসবকেই নিজেদের উৎসবের তালিকায় ঢুকিয়ে নিয়েছি। যেমন ধনতেরাস, বা কারবা চউথ, বা ধরুণ দেওয়ালী - এই সমস্ত উৎসব বাঙালিদের ছিল না কোনও কালেই। কিন্তু বাঙালি এতটাই উৎসব ভালোবাসে যে যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন থেকে শুরু করে বিহারী সম্প্রদায়ের বিশেষ পুজো ছট পরব - সব উৎসবকেই আপন করে নিয়েছে।
ভাইফোঁটা ভাই-বোনের মধুর সম্পর্ক এবং চিরন্তন ভালোবাসার একটি দিন। বিশেষ মুহুর্তে ভাইয়ের কপালে চন্দনের একটি ফোঁটা দিয়ে দিদি তার মঙ্গলকামনা ও দীর্ঘজীবন কামনা করে। সমস্ত রকম বিপদ আপদ থেকে সুরক্ষিত থাকার কামনাও করে থাকে। এই রিচ্যুয়াল বা প্রথা ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তার কোনও নির্দিষ্ট সাল তারিখ নেই। কথিত আছে যে, মৃত্যুর দেবতা যম তার বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়ে অমর হয়েছিলেন।
অন্যমতে নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে এই ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। তবে ভাইফোঁটা শুধু যে বাঙালিদের উৎসব তা নয়। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ‘ভাইদুজ’ নামে পরিচিত। মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে এই উৎসবকে বলা হয় ‘ভাইবিজ’। নেপালে বলা হয় ‘ভাইটীকা’।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের সাবেকি চেহারারও বদল ঘটবে সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তাই এখন এই ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া নামক উৎসবটির চিত্র কিন্তু আমূল বদলে গেছে। অথচ সেই অনেক বছর আগে যখন আমরা এবং আমাদের সমাজ এতখানি স্মার্ট হয়ে ওঠেনি তখন ঘরে ঘরে এই বিশেষ দিনটির ছবি কিন্তু অন্যরকম ছিল। দিদি বা বোন সকালবেলা স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে দুর্বা ঘাসের ডগায় পড়া শিশির দিয়ে চন্দন বেটে ভাইয়ের কপালে দই চন্দনের ফোঁটা দিয়ে শাঁখ বাজাত।
পাতে পড়ত বাড়ির তৈরী হরেক রকম মিষ্টি। তখন রংবেরঙ্গের বাজার চলতি মিষ্টির এত রমরমা ছিল না। তখন ছিল বাড়ির তৈরী সিরির নাড়ু, নানারকম সন্দেশ, বোঁদের লাড্ডু, লুচি, ঘুগনি, পায়েস ইত্যাদি। আর দুপুরে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া হত খাঁসির মাংস, আর ঝুরঝুরে সাদা চালের ভাত। উপহার হিসেবে বোন বা দিদিরা ভাইয়ের কাছ থেকে পেত শাড়ি। দিদিরাও অবশ্য ভাইদের প্যান্ট জামার পিস ইত্যাদি দিত।
কিন্তু এখন যুগ বদলেছে। ভাইফোঁটার এই সাবেকি চিত্র আর তেমনভাবে দেখা যায় না। একেবারেই যে যায় না তা নয়। তবে সংখ্যায় খুবই কম। বাড়িতে ভাইফোঁটার চল প্রায় উঠে গেছে বললেই হয়। এখন ভাইফোঁটা হয় ফাইভস্টার হোটেলে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বিয়ের মতো ভাইফোঁটারও যাবতীয় ব্যাবস্থা করে দেয়। মেনু থেকে গিফট - সব তারাই করে। ভাই বা বোন টাকা দিয়ে দিলেই হল। অত ঝামেলায় আর কে যায়! কারণ ভ্রাতৃ দ্বিতীয়াও এখন ব্র্যাণ্ডেড। কে কোন হোটেলে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পার্টি দেবে সেই নিয়ে চলে একটা ঠাণ্ডা প্রতিযোগিতা।
বাড়িতে রান্নার ঝামেলা সব শিকেয় তুলে দিয়ে ভাই-বোন তখন রেস্তোরাঁমুখী। যাদের পকেট অতটা পারমিট করে না তাঁদের জন্য রয়েছে মাঝারি বাজেটের রেস্তোরাঁ। শুধু পুজো উপলক্ষেই নয়, এই ভাইফোঁটাকে কেন্দ্র করেও রেস্তোরাঁগুলি ঢেলে সাজানো হয়। যারা বাইরে যেতে চান না তাদের জন্য রয়েছে ফুড ডেলিভারি সার্ভিস। এ তো গেল খাওয়া দাওয়া। গিফটেও এখন শুধুমাত্র শাড়ী বা জামা প্যান্টের গন্ডি থেকে মানুষজন বেরিয়ে এসেছে। তেমন শাঁসালো জামাইবাবু হলে দিদি ভাইফোঁটায় ভাইকে গিফটে দেয় সিঙ্গাপুর বা মরিশাসের হলিডে প্যাকেজ। যারা শাড়ি বা ড্রেস ম্যাটেরিয়াল দেন তাঁরাও দোকানে গিয়ে কেনার ঝামেলা করেন না। অনলাইনে অর্ডার দিলে, তারাই এসে দিয়ে যায় সেই উপহার।
তবে যেসব ভাই-বোন কর্মসূত্রে অনেক দূরে থাকে, যাঁরা এই বিশেষ দিনটিতেও বাড়ি আসতে পারে না তাদের কাছে এই দিনটি বড় বেদনার। সেই বোন বা দিদি দেশেই থাকুক বা বিদেশে; এই একটি দিন সে দূরে থেকেই ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে। ভাইয়ের নাম করে ফোঁটা দেয় দরজার চৌকাঠে বা দেওয়ালে। তাই অনেক আনন্দের মধ্যেও কোথাও যেন মিশে থাকে একটু চাপা বিষণ্ণতার সুর। এই দিনটি বিষণ্ণ তাদের কাছেও যাদের ভাই বা বোন নেই। এখন অনেকেই একটি সন্তানেই সুখী হতে চাইছেন।
কিন্তু যে ছেলেটি বা মেয়েটি একা একা বড় হয়ে উঠল, যে জানল না ভাই-বোনের ভালোবাসা ও খুনসুটি কতটা মধুর সে সত্যিই বড় অভাগা। আগেকার দিনে এই বিষণ্ণতা ছিল না। কারণ বাবা-মেয়ের একমাত্র সন্তান হলেও খুড়তুতো বা জ্যাঠতুতো ভাইবো্নের অভাব ছিল না যৌথ পরিবারে। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবার এখন ফসিল হয়ে গেছে। তাই এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েই জানে না দাদা বা বোন কি জিনিস! শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই বাস্তব।
তবে এখন এই পারিবারিক অনুষ্ঠান শুধুমাত্র পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এখন মানুষের জীবনের প্রতিটি ব্যক্তিগত মুহুর্ত এক্সপোজ হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফোঁটা দেওয়ার তর সয় না। প্রতিযোগিতা চলে কতক্ষণে সেই ছবি আপলোড করা হবে! ফেসবুকের কল্যাণে এখন প্রত্যেকেই সেলিব্রিটি। তবুও ভাইফোঁটা আসে প্রতিবছর। রীতিনীতি যতই বদলে যাক সেই চিরপুরাতন প্রথা নিয়ে আজও সে সমস্ত ভাইবোনের কাছে ঐশ্বর্যমন্ডিত এক বিশেষ আনন্দের দিন।