কিংবদন্তি ও ঐতিহ্যে লৌকিক দেবী ভাদু

কাশীপুরের রাজা। সেই রাজার ছোট্ট এক কন্যা। সেই কন্যাকে কোলে-পিঠে করেন, খেলান, খাওয়ান, গল্প শোনান, সঙ্গে শুয়ে ঘুম পাড়ান ভদ্রাবতী। 


ভদ্রাবতী গরীবের মেয়ে। রাজবাড়ির আশ্রিতা। একাধারে ধাইমা, স্তনদায়িনী মা, পালিকা মা। সব। কন্যের যখন যা প্রয়োজন, সবেতেই তিনি। সর্বক্ষণই তিনি।


ভদ্রাবতী রাজকন্যাকে আপন মেয়ের মতো ভালোবাসেন। রাজকন্যাও ভদ্রাবতীকে ভালোবাসেন নিজের মায়ের চেয়ে বেশি। দু'জনের সন্নিধানে দু'জনের বড় সুখের সময় কাটে।


সুখ থাকলেই অসুখ আসে। দুই মা-মেয়ের মধ্যেও এল।

Bhadu4 (1)

তখন ভাদ্র মাস। ভদ্রাবতী হঠাৎ একদিন অসুখে পড়লেন। সে অসুখ কিছুতেই সারতে চাইল না, দিন দিন বরং বাড়তে লাগল। রাজার বদ্যি, রাজার কোবরেজ কারও নিদানে কোন কাজ হল না। ভদ্রাবতী মারা গেলেন।



রাজকন্যা বয়সে নিতান্তই বালিকা। এই বয়সে এত প্রিয় একজনের মৃত্যু তাঁকে বড্ড নাড়া দিল। নাড়িছেঁড়া সন্তানের বুকে যে শোক জমে, রাজকন্যার বুকেও তাই জমল। তারপর ঝরে পড়ল আছাড়ি-পিছাড়ি কান্না হয়ে। সে-কান্না আর থামতেই চাইল না। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর খালি এক কথা, ওগো, তোমরা আমার ভদ্রাবতী মাকে বাঁচিয়ে দাও, যেমন করে পারো বাঁচিয়ে দাও, তাকে ছাড়া আমি থাকব কেমন করে!...



রাজকন্যার সেই কান্না শুনে অসহায় রাজার চোখে জল এল, রানির চোখে জল এল, আর সকলের মনে হতে লাগল, আহা গো, যদি পারতাম, তাহলে ভদ্রাবতী মাকে ফিরিয়ে এনে এখনই সোনারবরণ রাজকন্যার বুকভাঙা চোখের জল মুছিয়ে দিতাম! তারপরই দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল, হায় রে জীবন, সে কী আর সম্ভব!

 

রাজকন্যাকে কিছুতেই শান্ত করা গেল না। একদিন গেল, দু'দিন গেল। রাজকন্যা মুখে কুটোটিও কাটলেন না। তাঁর সেই এক গোঁ, আগে আমার ভদ্রাবতী মাকে ফিরিয়ে দাও...



রাজা-রানি কেউই তাঁকে বোঝাতে পারলেন না যে, যে যায় তাকে আর ফেরানো যায় না! বোঝাতে না-পেরে রাজা-রানি আরও অসহায় হলেন। ভদ্রাবতীকে কেমন করে ফেরাবেন! রাজকন্যাকে কেমন করে বাঁচাবেন!

Bhadu1 (1)

দ্বিতীয় ভাবনাটা যখন সবাইকে কাতর করে ফেলল, তখন এগিয়ে এলেন রাজবাড়ির মৃৎশিল্পী, যিনি বছর বছর ঠাকুরদালানে মা দুগ্গার মূর্তি গড়েন। ভাদ্র মাসে তখন সবে ঠাকুর গড়া শুরু হয়েছে। গড়তে গড়তে তাঁর মনে হল, ভদ্রাবতীকে তো আমি দেখেছি; আচ্ছা, ঠিক ওঁর মতো দেখতে একটি মূর্তি গড়ে দিলে কি রাজকন্যা শান্ত হবেন! যদি হন...দেখিই না একবার চেষ্টা করে!



শিল্পীমানুষের খুব বেশি সময় লাগল না। অল্প সময়েই তিনি গড়ে তুললেন ভদ্রাবতীর মূর্তি। আশ্চর্যের কথা, সেই মূর্তি পেয়ে সত্যিই রাজকন্যা শান্ত হলেন, তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামালেন। বললেন, ও মা, মা গো, আর তোমাকে হারাতে দেব না! আমায় ছেড়ে কোত্থাও যেতে দেব না, কিছুতে না!



রাজকন্যাকে এভাবে শান্ত হতে দেখে রাজা-রানি-রাজ্যবাসীর দুর্ভাবনা দূর হল। সকলেই সুখী হলেন।



তারপর রাজকন্যা যখন নিজের ঘরে নিজের হাতে ভদ্রাবতী মায়ের আসন পাতলেন, পুজো শুরু করলেন; তখন সকলেই সেই পুজোয় সামিল হলেন।



মা ও মেয়ের এই ভালোবাসা সাধারণের মনে এক অভূতপূর্ব শ্রদ্ধার জন্ম দিল। তাঁদের মনে হল, ধাত্রী মায়েরা তো আমাদের সবার মা। ধরিত্রীর মতো। তাহলে, ধাত্রী ভদ্রাবতীও তো রাজকন্যার মতো আমাদেরও মা, আমরাই বা তাঁর পুজো করব না কেন! ধীরে ধীরে তাঁরাও শুরু করলেন ভাদ্র মাসে ভদ্রাবতীর পুজো। মা কখনো কখনো তো মেয়েও হয়ে ওঠেন। তাই কালে কালে ভদ্রাবতী হয়ে উঠলেন কারও কাছে আদরের মেয়ে 'ভাদুমনি', কারও কাছে শুধুই 'ভাদু'।

Bhadu2 (1)

ছোটবেলায় জঙ্গলমহলে মা-ঠাকুমার মুখে ভাদু পুজো শুরু-সংক্রান্ত এই কিংবদন্তিটি বহুবার শুনেছি। বাঁকুড়ার অন্যান্য জায়গায়, পুরুলিয়া ও বীরভূমে এই সংক্রান্ত ভিন্ন ভিন্ন কিংবদন্তি রয়েছে। তবে আমাদের এখানে প্রচলিত এই কিংবদন্তির অন্তর্ভাবনাটি সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় এখানকার মূর্তি নির্মাণেও। 



জঙ্গলমহলের লক্ষ্মীসাগর এক সময় ভাদুর মূর্তি নির্মাণের জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। এখনও সেই ঐতিহ্য কিছুটা রয়েছে। এখানে দু'রকম মূর্তি তৈরি হয়। 'কৃষ্ণকলি' ও 'মেড় তোলা'। 



'কৃষ্ণকলি' অর্থাৎ চালচিত্রবিহীন ভাদু। এতে দাঁড়ানো ভঙ্গির ভাদুর কাঁখে থাকেন শিশু-কৃষ্ণ, আর ডান হাতের মুঠোয় থাকে শঙ্খ, বাঁ হাতে শালুক কলি। আর 'মেড় তোলা' বলতে বোঝায়, চালচিত্রযুক্ত মূর্তি। এতে ভাদুর ভঙ্গিমা বসা। কাঁখে শিশু-কৃষ্ণ। ডান হাতে শঙ্খ, বাঁ হাত শালুক কলি এবং ডান হাঁটুতে পোষা পাখি।



এখানে যেটা লক্ষ করার, সেটা হচ্ছে লৌকিক দেবীর কোলে পৌরাণিক কৃষ্ণ এলেন কেন? এরকমটা তো অন্য লৌকিক দেবীর ক্ষেত্রে চট করে দেখা যায় না। তাহলে?



আসলে, এখানেই লোকশিল্পীর শিল্পময়তা। মগ্নতাও। কৃষ্ণ যাঁর কোলে প্রতিপালিত হয়েছিলেন, সেই যশোদা ছিলেন কৃষ্ণের পালকমাতা। যশোদার ভূমিকা যেন কৃষ্ণের জীবনে ধাত্রীমাতা ও স্তনদায়িনী মাতার মতোই অনেকটা। লোকশিল্পী সেই ভাবনাগত দিক থেকেই যশোদা ও ভদ্রাবতীকে কোলে কৃষ্ণ দিয়ে কোথাও এক করে দিলেন। শুধু তাই নয়, একটি চিরন্তন ও শাশ্বত মাতৃত্বকে ব্যঞ্জনায় ধরে তাকে সম্মান দিলেন, শ্রদ্ধা জানালেন, মহিমান্বিত করলেন। জঙ্গলমহলের ভাদুর এটা একটা বিশিষ্ট দিক।



ভাদু পুজোয় কোন মন্ত্র নেই। আছে শুধুই গান। গানে গানে পুজো। সে-গান ছোট থেকে বুড়ো নানা বয়সের মেয়ে-মহিলারা একত্রে বসে সমবেত সুরে গেয়ে থাকেন, গেয়ে তাঁরাই পুজো করেন। এ-গান অদ্যিকালে একদা তাঁরাই রচনা করেছেন। বহু গান এখনও বংশ পরম্পরায় মুখে মুখেই বয়ে চলেছে আজও:

"ওমা ভাদুমনি।

বছর পরে হল তব আগমনী।

কি দিয়ে পূজিব তোমায় গো আমি কিছু নাহি জানি।

দয়া করে দাও মা আমায় রাঙ্গা চরণ দু'খানি..."



গীতরচনায় পুরুষের অবদানও অস্বীকার করা যায় না। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-সাদা বালিকাগজে ছাপা আট থেকে দশ পৃষ্ঠার ভাদু সঙ্গীতের বই বছর বিশেক আগেও বিক্রি হত। এখন আর হয় না। এই বইগুলো গ্রামীণ কবিরা রচনা করতেন। মৃৎশিল্পীর কাছে বই রাখা থাকত, ভাদু মূর্তির সঙ্গেই তাঁর কাছ থেকে অনেকে এই বই কিনে নিয়ে যেতেন। তবে, আজও সেই সব কেতাবি গান কিছু কিছু শুনতে পাওয়া যায়।



আগে ভাদ্র মাসের শুরু থেকেই বাড়ির মেয়েরা বাড়িতে ভাদু এনে প্রতি সন্ধ্যায় পুজো করতেন। চিঁড়ে, মুড়কি কিংবা দুধ রুটিও নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদন করা হত। সন্ধ্যামণি, দোপাটি, দুপুরমণি, মুরগিঝুঁটি, টগর, ঝিঙে প্রভৃতি সহজলভ্য ও সাধারণ ফুলে দেবীর পুজো হত। এই পুজো দু'তিনটি গান গেয়ে তবে সমাধা হত। এখন অবশ্য অত আগে থেকে দেবীকে আনা হয় না। আনা হয় কেবল ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির সকালে।

Bhadu3

আসল পুজো হয় অবশ্য এই ভাদ্র সংক্রান্তির দিনই। এ-দিন দেবীর জন্য বিভিন্ন রঙের শাড়ি দিয়ে ঘরের ভেতর ছোট্ট মণ্ডপ তৈরি হয়। মণ্ডপের গায়ে টুনি বাল্ব দিয়ে ফুলের মালা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়। তার মধ্যে এনে বসানো হয় দেবী ভদ্রাবতীকে। এ-দিন দেবীর নৈবেদ্যরও বাহার হয় খুব। তাতে থাকে খই-মুড়কি, আরসা পিঠে, রসের বড়া, ফল আর বড় বড় জিলিপি।



ভাদু পুজো উপলক্ষে আগে দোকানে দোকানে এক-একটা বিঘৎসাইজের জিলিপি তৈরি হত, মণ্ডপে মণ্ডপে সেই জিলিপি টাঙানো হত। কে কত বড় জিলিপি টাঙাতে পারে, তাই নিয়ে প্রতিযোগিতাও ছিল। এখনও জিলিপি তৈরি হয়, কিন্তু পেল্লায় সাইজের বড় একটা আর দেখা যায় না।



ভাদ্র সংক্রান্তিতে এত আয়োজনের কারণ, এ-দিন দেবীর জাগরণ। সন্ধ্যে থেকেই বাড়ি ও জ্ঞাতিগুষ্টির সব মেয়েরা-মহিলারা জমায়েত হন ভাদুর মণ্ডপে। সবাই মিলে সারারাত জাগেন গানে গানে। 



তারই মাঝে প্রহরে প্রহরে দলে দলে গাঁয়ের মেয়ে-বউরা ঘুরে ঘুরে এ-ওর বাড়িতে ভাদু দেখতে আসেন। তারপর চাপাচাপিতে বসে যান মণ্ডপের আর-সকলের সঙ্গে গান গাইতে। ভাদুর আগমনি, ভাদুর নিন্দে-মন্দ করে গান, তার উত্তর-প্রত্যুত্তরমূলক গান, কৃষ্ণলীলার গান প্রভৃতি মিলিয়ে মজা একেবারে জমে ওঠে। তারপর খানিক গল্পগুজব করতে করতে চা খেয়ে পান খেয়ে মুখ লাল করে তবে গিয়ে তাঁরা অন্য মণ্ডপের পথে পা বাড়ান। এইভাবেই কেটে যায় সারাটি রাত।



ভাদু গানে সুরের কোন বৈচিত্র্য নেই। সমস্ত গানই এক সুরে গাওয়া হয়। কিন্তু, মজাটা হচ্ছে, তারপরেও সমবেত সুরে গাওয়া সেই গান আজও নেশা ধরায় মনে, রাত জাগায়। পাড়ার মেয়েদের যুথবদ্ধ করে। পরদিন গানে গানে বিসর্জনের পর মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। অন্তরে জাগায় বছরভরের অপেক্ষা। আর তার মধ্যদিয়েই বেঁচে থাকেন গ্রামবাংলার ঘরোয়া দেবী ভদ্রাবতী আর তাঁকে নিবেদিত যুগান্তরের গান। আর এ-সবের মধ্যেই প্রবহমান রয় বাংলার শাশ্বত লোকইতিহ্য...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...