রাজনীতিক, কূটনীতিক, সমাজসংস্কারক, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক, লেখক ও প্রকাশক। এক অঙ্গেই অনন্য প্রাণশক্তি।
আযৌবন লড়েছেন শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞান মনষ্ক চেতনা ও দর্শনকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে ধরেছেন কলম। নিজের ছাপাখানায় প্রকাশ করেছেন সংবাদপত্র। প্রতিষ্ঠা করেন লাইব্রেরী। তাঁর জন্মভূমি তখনও পরাধীন। বুঝেছিলেন উপলব্ধিগত শিক্ষার প্রয়োজন। তৈরি করে ফেললেন বিশ্ববিদ্যালয়। নাকচ করতেন সেই সবকিছু যার নেই কোনও যুক্তিগত ভিত্তি।
সেসময় আকাশে বিদ্যুৎ প্রজ্জ্বলন ছিল মহাজাগতিক বিস্ময়। সাধারণের ভাবনায় এই ঘটনা ঐশ্বরিক রোষ। মুহুর্তের মধ্যে ঝলসে যেত ঘর - বাড়ি। এমনকি রেহাই পায়নি মন্দির - গির্জাও। মেনে নেননি তিনি এই অন্ধ প্রলাপ। বলেছিলেন বজ্রপাত কোনও ঐশ্বরিক ঘটনা নয়। তিনি আর অন্য কেউ নন, তিনি বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। বিজ্ঞানীরাও অপারগ স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে। কেউ কেউ ঈশ্বর ভয়ে পিছিয়ে আসতেন যুক্তিমূলক ব্যাখ্যা দেওয়া থেকে।
একদিন দুটি গুয়েরিক গোলকের মধ্যে বৈদ্যুতিক ডিসচার্জের ঘটনা নজরে আসে ফ্রাঙ্কলিন এর। দুটি চার্জড গোলক খুব কাছাকাছি এলে সৃষ্টি হয় বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের। বুঝলেন বজ্রপাত ও বিদ্যুতের মধ্যে একটা যোগাযোগ আছেই আর তা মহাজাগতিক নয়। এর রহস্য উদঘাটন সম্ভব। বেশ উঁচু কোনো জায়গায় একটি লোহার দন্ড রেখে সেটিকে যদি মাটির সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া যায়, তবে বজ্রপাতের বিদ্যুৎকে শর্ট সার্কিট করে সরাসরি মাটিতে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব হবে।
পরীক্ষার কথা মাথায় এলেও সম্ভব হচ্ছিল না পরীক্ষণ। কারণ সেখানে না ছিল তেমন সমতল আর না ছিল তেমন উঁচু কোনও জায়গা। যদিও কথা ছিল একটি গির্জা নির্মাণের। অর্থাৎ বেশ উঁচু একটি চূড়া পাওয়া যাবে। প্রহর গুনছেন গির্জা প্রতিষ্ঠার। ইতিমধ্যেই একটা চিঠি গিয়ে পৌঁছেছে রয়্যাল সোসাইটির ঠিকানায়। নিজের পরীক্ষার বিষয়ে জানালেন মার্কিন মুলুকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিলেন সভ্যরা। যদিও ফ্রান্সের একদল বিজ্ঞানী উৎসাহী হলেন। ‘ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট’ নাম দিয়ে শুরু হল নিরীক্ষা।
কিন্তু বেঞ্জামিন তখনও জানেন না এসবের কিছুই। ওদিকে অপেক্ষার বাঁধ ভাঙল তাঁর। কারণ ঘর - বাড়ি জ্বলছে, অথচ শুরু হচ্ছেনা গির্জার নির্মাণ। বেছে নিলেন অন্য পথ। উচ্চতার প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ঠিক করলেন ব্যবহার করবেন ঘুড়ি। ঘটার অপেক্ষায় ঐতিহাসিক ‘কাইট এক্সপেরিমেন্ট’। ১৭৫২ সাল। এক বজ্র মুখর দিনে আকাশে উড়ল ঘুড়ি। সহযোগী হিসেবে নিলেন পুত্র উইলিয়াম কে। ঘুড়িতে সুতোর বদলে লাগানো হল কপারের তার। কপার-তারের শেষ মাথায় বেঁধে দিলেন এক গোছা চাবি।
চাবিগুলো রেখে দিলেন লেইডেন জারের মধ্যে। এবার শুধু অপেক্ষা এক ঝলক বিদ্যুতের। আকাশে যখন বিদ্যুৎ চমকালো, তখন সেই বিদ্যুৎ ঘুড়ির কপারের তার অনুসরণ করে, চাবির মধ্য দিয়ে এসে জমা হলো লেইডেন জারে। চার্জশূন্য লেইডেন জারটি চার্জড হল আসমানি বিদ্যুতে। এরপর বাড়ির ছাদে একটি চোখা ধাতব দন্ড লাগিয়ে তারের সাহায্যে একে মাটির তলায় নিয়ে গেলেন। বিদ্যুৎ বাড়ির কাঠামোতে আঘাত না করে রডের মাধ্যমে সরাসরি চলে যায় মাটিতে।
আবারও ঘোষিত হল বিজ্ঞানের জয়। উড়ল বিজয় পতাকা। নেতৃত্বে নায়ক ফ্রাঙ্কলিন। মানুষ আবারও জানলো সাধারণ জীবনে বিজ্ঞানের অসাধারণ গুরুত্ব। চলে গিয়েছিলেন আজকের দিনে। জন্মভূমি ফিলাডেলফিয়া তেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ। যতদিন ঘুরবে সৃষ্টিশীল বিজ্ঞানের চাকা, ততদিন স্মরণে আসবেন