সন ১৯১১। দিনটা ১১ আগস্ট। এদেশের আকাশে মধ্যদিনের তেজ ছড়াচ্ছে ব্রিটিশ সূর্য। আর সেই তেজে খাঁ খাঁ পুড়ছে পরাধীন দেশের জনজাতি। রাজদন্ডের ঘায়ে গায়ে দগদগে কালশিটে। একবার মুখ খুলে খালি বন্দেমাতরমটুকু বললেই, ঠাঁই হবে কয়েদখানার অন্ধকার। শিশু-বৃদ্ধ-নারী-পুরুষ কারুর রেহাই নেই।
তার ঠিক ৩ বছর আগেই মুজাফফর নগরে কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার ঘটনায় ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছেন মেদিনীপুরের ১৮ বছরের ক্ষুদিরাম বসু। সেই ঘটনায় চোখের জলে ভেসেছিল গোটা বাংলা। তিন বছর পরেও শুকিয়ে যায়নি জলের দাগ।
কটকের র্যাভেনশ স্কুলের ছাত্ররা ঠিক করল তিন বছর আগের সেই দিনটিকে স্মরণ করবে তারা। ঘরের প্রায় পাশেই তমলুক, সেখানকার ভূমিপুত্র ক্ষুদিরামকে মনে করে ১১ তারিখ অনশন পালন হবে। সেদিন ঘরে ঘরে অরন্ধন। স্কুল হস্টেলের রান্নাঘরেও পাচক ঠাকুরের অঘোষিত ছুটি। ছেলেরা খাবে না। তবে তারা স্কুলে এলো যথারীতি। স্কুল ছুটির পর আয়োজিত হল সভা।
সেই ছেলেদের দলে ছিল ক্লাস নাইনের ছাত্র সুভাষও। কটকের বিশিষ্ট আইনজীবী জানকিনাথ বসুর পুত্র সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯০৯ সালে কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলের মেধাবী ছাত্র বাংলা মাধ্যমের র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়। প্রথম দিন স্কুলে এসেছিল সাহেবি পোশাক পরে। পরের দিন তাকে দেখে গেল ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবিতে। বাকি ছাত্রদের মতো পোশাকেই। অবাক হয়েছিল সহপাঠীরা। এমনকি সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকমশাইও। এদিনের উদযাপনে তার ভূমিকাও কিছু কম ছিল না।
এদিকে র্যাভেনশ স্কুলে ক্ষুদিরাম স্মরণের খবর পৌঁছেছিল কটকের ম্যাজিস্ট্রেটের কানেও। প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাশকে। তবে তিনি সেসবে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না মোটেই।
নিজে ছিলেন দর্শনশাস্ত্র, অর্থনীতি, ইতিহাসের পন্ডিত মানুষ। নিজের সেই ভাবনা ও বোধের ধারা ছড়িয়ে দিতেন নতুন প্রজন্মের মধ্যে। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া সুভাষের ভিতর আগুন দেখেছিলেন তিনি। সপ্তম শ্রেণীর সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া ছেলেটি অচিরেই হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় ছাত্র। ছাত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি। স্কুলের পাঠ্য বইয়ের বাইরের খুলে দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব বইঘরের দরজা।
১৮৮৬ সালে চট্টগ্রামের শেওড়াতলী গ্রামে জন্ম। বাবা কৃষ্ণ চন্দ্র দাশ। পড়াশোনা দর্শন নিয়ে। জীবন শুরু করেছিলেন চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসেবে। তখন এই স্কুলের নাম ছিল চট্টগ্রাম জেলা স্কুল। তাঁর হাতে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। তারপরে কটকে আসেন। র্যাভেনশ স্কুলে।
বেণীমাধব দাশ ছাত্র তৈরী করতেন। কিন্তু তা শুধুমাত্র বইমুখী পাশের পড়া দিয়ে নয়। সমকালীন সমাজ, দর্শন আর দেশকে জানার মধ্যে দিয়ে। সেই পাঠ দিতে গিয়েই কাঁচা মনে বুনে দিতেন দেশকে ভালোবাসার বীজ।
ইউরোপী স্কুল থেকে বাংলা মাধ্যমে সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্রটিকে তাই জিজ্ঞেস করেছিলেন তার দেশি পোশাকে বদলে যাওয়ার কারণ। উত্তরে ছাত্র সুভাষ বলেছিল,
“আজ্ঞে, ওটা মিশনারী স্কুলের পোষাক ছিল। কিন্তু এখানে যখন দেখলাম সবাই দেশী পোষাক পরে আসে তখন মনে হল আমার ও ওদের মত পোষাক পরে আসা উচিত।”
উত্তরে প্রসন্ন হয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাশ। সুভাষচন্দ্র সে বছর সব সাবজেক্টে একশোয় একশো পেয়েছিলেন। বাংলা আর সংস্কৃত জানতেন না। প্রচন্ড অধ্যাবসায় দিয়ে শিখে নিয়েছিলেন দুই ভাষাই। দুটোতেই একশো পেয়ে ক্লাসের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন।
সুভাষচন্দ্রকে বিবেকানন্দ পড়তে শিখিয়েছিলেন তাঁর মাস্টারমশাই। কৈশোর থেকে যৌবনমুখী ছাত্রটি অন্য পথে, অন্য জীবনের খোঁজ পেয়েছিলেন সেই পথেই।
বেণীমাধব দাস শিক্ষকতা ছাড়াও বহুমুখী কর্মকান্ডে জড়িয়ে ছিলেন। ব্রাহ্ম আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। ব্রাহ্ম সমাজ থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার ও নববিধান-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত লিখতেন। দেশের কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কাকিনাদায়, বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া থেইস্টিক কনফারেন্সের সভাপতিত্ব করেন। সভাপতি হিসাবে তার ভাষণ পরে মডার্ন থেইস্টিক মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া নামক পুস্তিকায় প্রকাশ করা হয়। তার প্রবন্ধ সংকলন পিলগ্রিমেজ থ্রু প্রেয়ার্স সমালোচকদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল।
যাইহোক, সেদিন স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে ক্লাসরুমে ক্ষুদিরামের প্রয়াণ দিবস পালনের ঘটনা খুব ভালভাবে নেয়নি ইংরেজ প্রশাসন। তার শাস্তি হিসেবে র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধানশিক্ষককে বদলি করে দেওয়া হয় কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে।
বিচ্ছেদ ঘটেছিল ছাত্র-শিক্ষকের। তবে সেই বিচ্ছেদ নেহাতই চোখের দেখার বিচ্ছেদ। মাস্টারমশ্যাই বেণীমাধব দাশের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর যোগাযোগ থেকেই গিয়েছিল। তাঁর প্রতিটি কার্যক্রমের খবর রাখতেন তিনি। আশির্বাদ ও পরামর্শ নিতেন প্রিয় শিক্ষকের থেকে। যে ছাত্র দেশমায়ের সেবার জন্য অবলীলায় ছাড়তে পারেন সেরাতম চাকরির প্রস্তাব তেমন ছাত্রের জন্য গর্বিত ছিলেন আজীবন।
সুভাষচন্দ্র বসু নিজেও তাঁর ‘ভারত পথিক’ বইতে লিখেছিলেন তাঁর জীবনে র্যাভেনশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধববাবুর অবদানের কথা।
পুরোদস্তুর রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য দেশপ্রেমিক শিক্ষাব্রতী বেণীমাধব দাশ তাঁর দুই কন্যাকেও তৈরী করেছিলেন দেশপ্রেমের আদর্শ দিয়েই। বীণা দাশ কল্যানী দাশ। স্ত্রী সরলা দাশ দুঃস্থ মহিলাদের জন্য তিনি পরিচালনা করতেন 'পুণ্যাশ্রমে'র। তাঁদের দুই কন্যায় বিপ্লবের পথে হেঁটেছিলেন।
বিপ্লবী লিফলেট বিলির অভিযোগে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করেছিল কল্যাণী দাশকে। তৃতীয় শ্রেণীর বন্দি হিসেবে তাঁকে রাখা হয়েছিল জেলে। অবর্ণনীয় অত্যাচারের মুখে পড়তে হয় নিজের জ্যেষ্ঠা কন্যার এমন জীবন সামনে থেকে দেখেছিলেন বেণীমাধব দাশ। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। কনিষ্ঠা কন্যা বীণা দাশও বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াননি, বরং এগিয়ে দিয়েছিলেন।
বীণা দাশ ছিলেন বেথুন কলেজের ছাত্রী। একেবারে শুরুতে গান্ধীজীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। পরে সেই বিশ্বাসে ভাঙন ধরে। স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানাতে গর্ভনর জ্যাকসনকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নেন। অস্ত্র জোগাড়ে সাহায্য করেন বন্ধু কমলা দাশ।
খোঁপায় রিভলবার লুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন কক্ষে এসেছিলেন। বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করেন কক্ষের মধ্যেই কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলেন তিনি। গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।
কোথা থেকে তিনি অস্ত্র জোগাড় করলেন সেই কথা উদ্ধারে অকথ্য নির্যাতন চলে বীণার ওপর। তাঁর বাবার ওপরও চাপ দেয় পুলিশ মেয়েকে মুখ খোলাতে কিন্তু তিনি ছিলেন সিংহ বিক্রমের পুরুষ। জানতেন তাঁর মেয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য সব দিতে প্রস্তুত, প্রচন্ড ঘৃণায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশের প্রস্তাব।৯ বছর কারাগারে ছিলেন বীণা দাশ।
স্মিতবাক মানুষটি কখনও হার মানেননি পরিস্থিতির কাছে। তিনি আদর্শ পিতা শুধু নন, আদর্শ শিক্ষকও। ছাত্র আর সন্তান এক হয়ে যেত তাঁর কাছে। তাদের প্রতি শিক্ষা এবং দর্শনও এক।
সুজনা সুফলা শস্য শ্যমলা বাংলাদেশের মানুষ তিনি। কোথা থেকে পেয়েছিলেন এই মনের জোর, এই দৃঢ়চেতা স্বভাব, কীভাবেই বা গড়ে উঠেছিলেন প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাশ, সেসব জানার সুযোগ বিশেষ নেই। কিন্তু যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন সেই লড়াইয়ের পথ থেকে কখনও সরেননি। দেশভাগ দেখেছিলেন, পীড়া পেয়েছিলেন দাঙ্গায়, কিন্তু তাঁর আনন্দ ছিল তাঁর ছাত্ররা। তাঁর কন্যারা। যাদের চোখে তিনি নিজের আদর্শের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। তারই ফসল আজকের স্বাধীনতা। কিন্তু নেপথ্যের কারিগরকে কজন মনে রেখেছে!
১৯৫২ সালের ২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর প্রয়াণ ঘটে।