প্রমোটার-কবল থেকে উদ্ধার করতে ‘দেব সাহিত্য কুটির’ প্রকাশনী সংস্থার অফিসকে ‘হেরিটেজ’ তকমা প্রদান করল পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন। উত্তর কোলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের ঝামাপুকুর লেনে অবস্থিত এই শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটির সাথে অতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বিদ্যাসাগরের স্মৃতি। অধিক মুনাফা অর্জনের লোভে গড়ে ওঠা প্রমোটার চক্রের আবর্তে পড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল বাড়িটি, সঠিক সময়ে বাড়িটিকে সংরক্ষণ করতে এগিয়ে আসে রাজ্যের হেরিটেজ কমিশন। বুধবার, সেই সিদ্ধান্তেই সরকারি শিলমোহর পড়ে।
একদা এই ভবনে নিত্যদিনের যাতায়াত ছিল বিদ্যাসাগরের। এখান থেকেই প্রকাশিত হত বর্ণপরিচয় সহ বিদ্যাসাগরের লেখা অন্যান্য বই। বর্তমানে এই ভবনে রয়েছে দেব সাহিত্য কুটির সংস্থার অফিস। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ দেবনাথ সহ লেখকজগত-সঙ্গীতজগত তথা শিল্পজগতের বহু বিশিষ্ট শিল্পী প্রায়ই কাজের সূত্রে আসতেন এ বাড়িতে। এমনকি উত্তমকুমার-সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ও এ বাড়িতে কাটিয়ে গেছেন বহু মূল্যবান সময়। প্রমোটারের হাতে চলে যাওয়ায় শতাব্দীপ্রাচীন বড়িটির সঙ্গে দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশনীর অফিসের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিদ্যাসাগরের স্মৃতি রক্ষার্থে এগিয়ে আসে রাজ্যের হেরিটেজ কমিশন।
“লড়াইটা যখন শুরু হয় তখন আমি একাই শুরু করেছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে এই লড়াইয়ে বহু মানুষ সামিল হতে শুরু করেন, তাই এটা স্রেফ আমাদের জয় নয়, দেবসাহিত্য কুটিরের আপামর পাঠককূল, যাদের ছেলেবেলা শুরুই হয়েছিল শুকতারা, হাঁদা ভোদা, বাটুল দ্যি গ্রেট, নবক্ললোল পড়ে, তাদের সকলের জয় এটা। বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল এই ছাপাখানা থেকে, ভবনের প্রতিটি কোণ বিদ্যাসাগরের স্মৃতি বহন করছে, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের এই সিদ্ধান্তে আমরা একই সাথে গর্বিত ও আনন্দিত,” স্মৃতিচারণ করতে করতে খানিকটা আবেগপ্রবণ কন্ঠে বললেন দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার রুপা মজুমদার, বর্তমানে ‘শুকতারা’ ও ‘নবকল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তিনি।
একসঙ্গে ১৫ জন বিধবা মহিলার বিয়ের খরচ জোগাতে গিয়ে তাঁর সাধের ছাপাখানা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন বিদ্যাসাগর। ১৮৬০ সালে ঝামাপুকুরের একটি ছাপাঘরে প্রথম এই ছাপাখানাটি চালু হয়েছিল, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বরদাপ্রসাদ মজুমদার, তার নাম কেন্দ্র করেই এই প্রাচীন ছাপাখানার নামকরণ করা হয়েছিল বিপিএম প্রেস। ১৮৯০ সাল থেকে ঝামাপুকুর লেনের বিপিএম প্রেস থেকে 'বর্ণপরিচয়' ছাপা শুরু হয়। ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হলে আর্তদের সেবার স্বার্থে বাজারে যে বিপুল দেনার স্তূপ জমা হয়েছিল, তার তালিকা জড়িয়ে যায় বিদ্যাসাগরের নামের সাথে; এবং তার ফলস্বরূপ বিদ্যাসাগরের লেখা 'বর্ণপরিচয়', 'বোধদয়', 'কথামালা', 'উপক্রমণিকা' প্রভৃতি বইগুলি হাইকোর্টের রিসিভারের হাতে চলে যায়।
১৯২৪ সালে বিপিএম প্রেসের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় দেব সাহিত্য কুটির। সে বছরই বিদ্যাসাগরের লেখা যাবতীয় বই ছেপে বিক্রি করার জন্য হাইকোর্ট নিলাম ডাকে। তার সূত্রেই বিদ্যাসাগরের সমস্ত বই ছাপার অধিকার লাভ করে দেব সাহিত্য কুটির। তখন থেকেই ঝামাপুকুর লেনের দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশনী সংস্থা থেকে বর্ণপরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ সহ বিদ্যাসাগরের লেখা অন্যান্য বইগুলি টানা প্রকাশিত হয়ে আসছে। হাইকোর্টে নিলামে যে স্বত্ব হস্তান্তর হয়েছিল, বর্ণপরিচয়ের রিসিভার সংস্করণে আজও তা উল্লেখ করা থাকে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেব সাহিত্য কুটিরের জনপ্রিয় পত্রিকা 'শুকতারা' প্রকাশিত হয়ে আসছে। এই প্রকাশনী সংস্থার আরও একটি জনপ্রিয় পত্রিকা 'নবকল্লোল' আজও একইভাবে পাঠককূলের চাহিদা মিটিয়ে চলেছে।