বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, চৈত্র মাসের শেষ দিন বা চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয় চড়ক পুজো। এটি মূলত বাঙালি হিন্দুর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তথা পল্লীবাংলার জনপ্রিয়তম লোকোৎসব। নববর্ষের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পুজো উৎসব চলে। লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবের আরাধনা এবং উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব প্রচলিত ছিল।
চৈত্র মাস জুড়ে বাঙালিদের নানা পুজো ও আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয় চড়কের পুজো। এই পুজোর সূচনা নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। আসুন জানা যাক যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই পুজোর সঙ্গে জড়িত কাহিনী। চড়ক পুজো কবে কী ভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। তবে প্রচলিত রয়েছে, ১৪৮৫ সালে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। রাজ পরিবারের লোকজন এই পুজো আরম্ভ করলেও চড়কপুজো কখনও রাজ-রাজড়াদের পুজো ছিল না। এটি ছিল হিন্দু সমাজের লোকসংস্কৃতি। পুজোর সন্ন্যাসীরা প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের তথাকথিত নীচু সম্প্রদায়ের লোক। তাই এই পুজোয় কোনও ব্রাহ্মন পুরোহিতের প্রয়োজন পড়ে না।
লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবের আরাধনা এবং উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। তবে চড়ক পুজো কবে কী ভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় না পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এই পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। সমাজের তথা কথিত উচ্চস্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল না।
কথিত আছে, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সংগে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষায় ভক্তিসূচক নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করেন,রাজ পরিবারের লোকজন এই পুজো আরম্ভ করলেও চড়কপুজো কখনও রাজ-রাজড়াদের পুজো হয়ে উঠতে পারেনি।
গম্ভীরাপুজো বা শিবের গাজন এই চড়কপুজোরই ভিন্ন প্রকারভেদ। পুজোর আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, ওই প্রতীকি শিবলিঙ্গ 'বুড়োশিব' নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এই পুজোর পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পুজোর বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হল কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পুজো করা। পুজোর পরেই সন্ন্যাসীরা উপবাস ভাঙেন।
এই সব পুজোর মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। পুজোর উৎসবে নানা রকমের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মেরই অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিভে এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনও কখনও জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। চড়ক পুজোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির সদৃশ্য লক্ষ করা যায়। পুজোর উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।
১৮৬৩ সালে বা মতান্তরে ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে বন্ধ করলেও গ্রামবাংলার যে সব অঞ্চল মূলত কৃষিপ্রধান সেখানেই চড়ক পুজো উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আজও চড়ক বাংলার অন্যতম প্রধান লোকউৎসব। দুই বাংলাতেই চৈত্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পুজো। চৈত্র মাসে শিবের ভক্তরা ভোলানাথের উপাসনা করে থাকেন। চড়কের প্রচলন নিয়ে গ্রামীণ লোককথায় বলা হয়, পরম শিবভক্ত বাণরাজা যুদ্ধ করেছিলেন দ্বারকার অধিপতি তথা বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর অমরত্ব পাওয়ার আশায় তিনি চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুচরদের নিয়ে নাচে গানে আত্মহারা হয়ে নিজের শরীরের রক্ত বের করে সমর্পণ করেন শিবের উদ্দেশ্যে। সেই ঘটনার স্মৃতিতেই প্রত্যেক বছর এই দিনে চড়ক উৎসব পালন করা হয়। গবেষকরা বলেন, পাশুপত সম্প্রদায় এই উৎসব পালন করত প্রাচীনকালে। মূলত হিন্দু সমাজের সাবঅল্টার্ন অংশের মানুষেরা এটি পালন করেন।
গাজন উৎসবের অঙ্গ হল চড়ক। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, শিবলোক প্রাপ্তির জন্য চৈত্র মাসে নৃত্য উৎসব পালন করতে হয়। রানি রঞ্জাবতী ধর্মঠাকুরকে সন্তুষ্ট করতে গাজন উদযাপন করেছিলেন, এই ঘটনার বিবরণ রয়েছে ধর্মমঙ্গলে। কেউ কেউ বলেন, বৌদ্ধ প্রভাব আছে গাজনে। মূলত এটি হিন্দুদের উৎসব, তবে মুসলমানের অংশগ্রহণও দেখা যায় কোনও কোনও জায়গায়। যেমন হাওড়া জেলায় পির জঙ্গল বিলাসের দরগায় শিবের গাজন হয়।