বাংলার প্রাচীন ঐশ্বর্য

অজানাকে জানা -চেনার একটা প্রবণতা  ও কৌতুহল মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি, আর সেই নেশায় মানুষ এক জায়গা থেকে অন্যত্র ছুটে যায়, তা সে যত দুর্গমই হোক না কেন। কিন্তু এই কথা কি অস্বীকার করা যায় যে, চেনা গন্ডিও  একসময় অচেনা মনে হয়। ঠিক তেমনি কলকাতার সবটুকু নিংড়ে তার অজানা চরিত্রের সবটা কি আমরা জানি! না জানতে চাই! এই তিলোত্তমা কোথায় না কোথায় তার আভিজাত্য লুকিয়ে রেখেছে এই আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়েও সেটা কম কি! আর সেটা জানতেই পুরোনো কলকাতার এক ইতিহাস বলবো। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা কিন্তু প্রায় রোজের চেনা গলি, অথচ সেখানকার ইতিহাসের রসদ যে কি সাংঘাতিক মূল্যবান তা কল্পনাতীত। আজ তেমনই এক জায়গার কথা বলি, যা খুব পরিচিত।

                             

                     টালিগঞ্জ রোডের ওপর প্রায় দুশো বছরের কাছাকাছি মূল শিবমন্দির সহ দ্বাদশ শিবমন্দির বিশিষ্ট  -ছোট রাসবাড়ীর সরকারি ঠিকানা ৯৩ টালিগঞ্জ রোড। যা  কিছুদিন হলো মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের অধীনে হেরিটেজ বিল্ডিঙের স্বীকৃতি পেয়েছে। যার সামনে মাঠের মতো অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। সামনেই একটি   জরাজীর্ণ বাধানো ঘাট। মাঠের খানিক  উত্তরে  উঁচু প্রাচীরপরিবৃত একটি ক্ষেত্র, একটু ভালো করে দেখলেই উঁকি মারবে একটি নবরত্ন, ও কয়েকটি আটচালা মন্দিরের চূড়া।  এগোলেই চোখে পড়বে মৃতপ্রায়  চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে মন্দিরের  প্রবেশদ্বার। প্রবেশপথের বাইরের দেওয়ালে সেই সময়ের বাংলা - সংস্কৃত ভাষায় লিখিত একটি ট্যাবলেট।

      

ইতিহাস সন্ধানে প্রাথমিক ভিত্তি কিন্তু এই ট্যাবলেট, যারা ট্যাবলেট বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন তাদের ক্ষেত্রে  বলে রাখি, এ ট্যাবলেট খাওয়ার নয়, তথ্য সমৃদ্ধ। অতীতে  অনেক ইতিহাস, তথ্যের আধার এসব ট্যাবলেট।  যা অবশ্যই মগজের পুষ্টিদায়ী। যাইহোক তা কালের নিরিখেই ঔজ্বল্য  হারিয়ে হয়েছে অস্পষ্ট। তাই বোধগম্য সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ। যদিও ইতিহাস জানায় প্যারিলাল দাস আর মণিমোহন দাসের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে কাজ শুরু হয় ১৮৪৬ সালের মার্চ মাসে, আর তা শেষ হয় ১৮৪৭ সালের এপ্রিলে। সেই হিসেবে এই মন্দিরগুলি ১৭৩ বছরের প্রাচীন।

                                  

                                  প্রবেশপথ  জানান দেয় মন্দিরের পরিণতির কথা। ভেতরে ঢুকেই একটি উঠোন, সাদা কালো মার্বেল দিয়ে দাবার ছকের মতো করে তৈরি। ভেতরে ঢুকেই ডানদিকের দেওয়ালে কালো পাথরের একটি বড় ফলক বা ট্যবলেট দেখা যায়। আর সেখান থেকেই বিস্তারিত তথ্য জানা  যায়। সদর দরজার ঠিক বিপরীতে, একটি বিশাল নবরত্ন মন্দির, যার  অলঙ্করন চূড়ান্ত অবহেলার শিকার। তার ঠিক দুপাশে দুটি ছোট পঞ্চরত্ন মন্দির। আর বাকি তিনদিক ঘিরেই টানা বারান্দা, সবগুলি বারান্দা ঘিরে মোট বারোটি শিবমন্দির। প্রত্যেক শিবমন্দিরের আলাদা নামকরণ আছেভুবনেশ্বর, রামচন্দ্রেশ্বর, কৈলাশনাথ, ভুটনাথ, সরেশ্বর, গোবিন্দচন্দ্রেশ্বর, নাকুলেশ্বর, কমলাকান্তেশ্বর, ভোলেনাথ, তারকনাথ, রতনেশ্বর এবং গোপেশ্বর। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এখানে একটি ছোট সংলগ্ন ঘর রয়েছে যা মূলত নৈবেদ্য প্রস্তুতির জন্য ব্যবহৃত হতো এবং এখনো হয়। তিনদিকের বারান্দার শিবমন্দিরগুলি কিন্তু আবার বাংলার আটচালা স্টাইলের। অর্থাৎ এই মন্দির চত্ত্বরে মূল মন্দিরটি নবরত্ন, দুটি পঞ্চরত্ন এবং দশটি আটচালা মন্দিরের সহাবস্থান। নবরত্ন মন্দিরে বিরাজ করছেন বর্তমানে গোপাল জীউয়ের অষ্টধাতু নির্মিত বাকি কষ্টিপাথরের বিগ্রহ, মন্দিরের পুরোহিত শ্রী অরুন কুমার চক্রবর্তী মহশয়ের কথানুযায়ী এই বিগ্রহের পাশে থাকা রাইসুন্দরীর মূর্তি চুরি যায় আজ থেকে পঞ্চাশ- ষাট বছর আগে। তবে সুখের বিষয়, নতুন এক শ্রীরাধিকার মূর্তি এ বছরেই পুনঃস্থাপিত করা হবে। বারান্দা ঘিরে বাকি সব শিবমন্দির। মন্দিরগুলিতে এখনো নিত্য পূজো হয়, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দেওয়াল জীর্ণ হয়ে পড়ে ভেতরের ইঁট বেরিয়ে পড়েছে!

                  

    এখানকার প্রধান উৎসব রাস এবং এটি চৈত্র মাসে একটি পূর্ণিমার দিনে হয়। সামনের মাঠে বসতো মেলা, শেষ বসে ২০০১ সালে। মন্দির কমপ্লেক্সের বা- কোণে এখনও মেহগনি কাঠের তৈরি একটি রাসমঞ্চ দেখা যায়। এতে সুন্দর ডিজাইন এবং কৃষ্ণ লীলার গল্প রয়েছে। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের মতে সাত বছর আগে রাসমঞ্চ সর্বশেষ ব্যবহৃত হয়েছিল।

      কিন্তু  এই মন্দিরের ইতিহাস আরো বেশি করে জনসমক্ষে আনতে ঠিক মতো সংস্কার প্রয়োজন। তা সরকারের হাত ধরে হলে মন্দ কি! আর তা করতে পারলে এ মন্দির যে তার পুরোনো গরিমা ফিরে পাবে ও অনেক উৎসাহী পর্যটকদের ভিড় বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

       

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...