"সাহেব তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি,
তোর পাদ্রী সাহেব শুনতে পেলে,
গালে দেবে চুনকালি।।"
জন্মসূত্রে একজন পর্তুগিজ এই গানের রসে মজেছিলেন। বাংলা ভাষাকে আপন করেছিলেন। কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির নাম শোনেননি এমন বাঙালি নেই বললেই চলে।
চারণ কবি মুকুন্দ দাস ছিলেন একজন কবিয়াল, যাঁর গান স্বাধীনতা সংগ্রামে জোয়ার এনেছিল।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কবিয়াল ভোলা ময়রা সম্পর্কে বলেছিলেন "বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের"।
বাংলা সাহিত্য, সিনেমায় কবিয়ালদের জীবন চিত্র বার বার উঠে এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় 'কবি' উপন্যাসে কবিয়ালদের কথা বলেছেন। চারণ কবি মুকুন্দ দাস, ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিদের নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছে। সেগুলো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বরগুপ্ত কবিগান সংগ্রহ করা আরম্ভ করেছিলেন। শুধু সংগ্রহ করেন নি, নিজের পত্রিকা 'সংবাদ প্রভাকরে' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। পত্রিকার মাধ্যমে কবিগানের বিস্তৃতি ঘটে।
বীরভূম জেলার গোঁজলা গুঁই (আনুমানিক ১৭০৪ জন্ম) সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল বলে মনে করা হয়। এঁর একটিমাত্র গান কবি ঈশ্বরগুপ্ত সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিখ্যাত কবিয়াল ছিলেন নিত্যানন্দ বৈরাগী, রামবসু, ভবাণী বণিক প্রমুখ।
সপ্তদশ শতকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে একধরণের ছড়া-গান ঢোল ও কাঁসি সহযোগে গাওয়া হতো। এই ছড়া গীতির প্রাচীন নাম 'আর্যাতর্যা'। সাধারণত শিব বা ধর্মঠাকুরের গাজন উপলক্ষে এগুলি গাওয়া হতো। ছড়াকাটাকাটির এই সাহিত্য যুদ্ধকে বলা হতো 'দাঁড়াকবি'। পরে এগুলো থেকেই জন্ম নেয় কবিগান।
উতোর-চাপান গান যাঁরা বাঁধতেন তাদের বলা হতো কবিয়াল বা কবিওয়ালা। পরবর্তীকালে দু-দলের উতোর-চাপান বিশিষ্ট তাৎক্ষণিক আসরকেন্দ্রিক গানকেই বলা হয় কবিগান।
কবিগানের বিকাশ কাল ১৭৬০-১৮৩০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কলকাতা শহরের পত্তন এবং এই শহরকে কেন্দ্র করেই কবিগানের বিকাশ ঘটেছিল।
প্রাচীন কবিগান চতুরঙ্গ পর্যায়ে বিভক্ত। ক) বন্দনা খ) সখী সংবাদ গ) বিরহ ঘ) খেউর। খেউর হল কবিগানের অবক্ষয় যুগের বিকলাঙ্গ ফসল। রাধাকৃষ্ণ প্রেম, উমাসঙ্গীত ও শ্যামাসংগীত হল কবিগানের প্রধান উপজীব্য বিষয়।
কবিগান সাধারণত দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে গীত হয়। প্রতিদলের নেতৃত্বে থাকেন একজন কবিয়াল বা সরকার। তাঁর সহকারী গায়কদের বলা হয় দোহার। এঁরা সাধারণত নেতার কথা পুনরাবৃত্তি করেন।
কবিগান শুরু হয় 'বন্দনা' বা 'গুরুদেবের গীতের' মাধ্যমে। বন্দনা অংশটি সরস্বতী, গণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এরপর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়ে থাকে। এটিকে 'আগমনি' বলা হয়।
বন্দনা, সখী সংবাদ, বিরহ ও খেউরের পর শুরু হয় প্রতিযোগিতামূলক অংশটি। কবিগানের আসরে এই অংশটিকে 'কবির লড়াই'ও বলা হয়।
এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান তৈরি করে অপর গীতিকার বা সুরকারকে আক্রমণ করেন। তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।
কবিগান যুগসন্ধিক্ষণের গান। বাংলা কাব্য-মুক্তির প্রথম কাকলি এই গানে শ্রুত হয়েছিল। কবি বিহারী লাল চক্রবর্তীর কবিতায় প্রথম বাংলা গীতিকবিতার সুর ধ্বনিত হয়েছিল। এটি সূচিত করে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ। ঈশ্বর গুপ্ত প্রাচীন ও নবীন যুগের মধ্যে সেতু রচনা করেছিলেন তাঁর খণ্ড কবিতাবলী দিয়ে।
কবিগানের অবক্ষয়ের ফলে মধ্যযুগে আবিভূর্ত হয়েছিল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালী ও ঢপের গান। এর মধ্যে দিয়েই নিধুবাবুর টপ্পা বাংলার সংগীত পরিমণ্ডলে নতুন রসের সঞ্চার করেছিল।