সাত পাকে বাঁধা পড়লেন পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রূপান্তরকামী দম্পতি দীপন চক্রবর্তী ও তিস্তা দাস। মানবিকতার দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে নিঃসন্দেহে এটি একটি দুঃসাহসিক জয়যাত্রা। এ এক নিয়ম ভাঙ্গার বন্ধন, যেখানে সম্প্রতি সামিল হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের এই নবদম্পতি।
আগরপাড়ার বাসিন্দা তিস্তা বর্তমানে টলিউড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। অতীতে নাম ছিল সুশান্ত, একটা সময়ের পর ভীষণভাবে অনুভব করছিলেন নারী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা, সেই সূত্র ধরেই ১৫ বছর আগে সম্পন্ন করেছিলেন ‘সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি’। এ দিন লাল বেনারসীতে সুসজ্জিত হয়ে কনে রূপে ছাদনাতলায় হাজির হয়েছিলেন ৩৮ বছরের তিস্তা, পাশে চলছিল পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ প্রক্রিয়া।
অন্যদিকে, লামডিঙের বাসিন্দা ৪০ বছরের দীপনের পূর্বনাম ছিল দীপান্বিতা। বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি জানালেন, “তিস্তাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে ভাগ্যবান মনে করছি। এটা আমার জীবনের সেরা দিন।“
আগরপাড়ার মহাজাতি অঞ্চলে এই বিবাহ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়। বিশেষ বিবাহনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করতে তিস্তার বন্ধু-বান্ধব সহ পাড়া প্রতিবেশী, সকলেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে। “আমার মেয়ে দীপনের মতো একজনের সঙ্গে সেটল্ হওয়ায় আমি খুশী। আমরা একটা কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, আমার মনে হয় অভিভাবকদের সবসময় সন্তানদের পাশে থাকা উচিৎ।“ বলছেন (শুভ্রা) তিস্তার মা।
তিস্তার মা ব্যাপারটিকে সমর্থন করলেও দীপনের নতুন পরিচয় মেনে নেন নি তাঁর অভিভাবক, ফলে অনুষ্ঠানটিতে দীপনের বাড়ি থেকে কেউই অংশগ্রহণ করেননি। যদিও দীপনের ফ্ল্যাটের মালিক এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছেন এবং বউভাতের যাবতীয় অনুষ্ঠানের ভার তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। ঐ দিনই আইননানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয় তাঁদের।
গত চার মাস ধরে চলছিল বিয়ের প্রস্তুতি। ১৫ই এপ্রিল জাতীয় ট্রান্সজেন্ডার দিবসের দিন নিজেদের বিয়ের কথা ঘোষণা করেন এই নবদম্পতি। ২১শে জুলাই থেকে শুরু হয় আইবুড়ো ভাতের আচারানুষ্ঠান পর্ব।
“আমাদের সম্প্রদায়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিস্তা। এটা করতে সাহস লাগে, আমি ওকে সাল্যুট করি,” জানিয়েছেন তিস্তার রূপান্তরকামী বান্ধবী শ্রেয়া।
পুরোহিত বিশ্বজিৎ মুখার্জীর কাছে এটা ছিল একটা বিস্ময়কর চমক। “এরকম আমি আগে কখনও দেখিনি। এটা একটা ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান এবং আমি এখানে অংশ নিতে পেরে আনন্দিত। এমন কি এখানে আসার জন্য আমি অন্য একটা কাজ বাতিল করেছি।“ বলছেন সেই রাতের পুরোহিত বিশ্বজিৎ মুখার্জী।
“এই বিবাহ ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটিতে অনেকটাই ইন্ধন জোগাবে। এর ফলে সমাজ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকে অনেকটাই মুক্ত হবে তাঁরা। দীপন ও তিস্তাকে আমি নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানাই। ওরা দুজনেই খুব ভালো মানুষ,“ বলছেন অপরাজিতা বসু (‘হিউম্যান রাইটস্ ল কলকাতা’র এক সদস্য)।
সব মিলিয়ে দীপন-তিস্তার এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত শুধু ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির কাছেই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো না, আদর্শ প্রেমেরও একটি সুলিখিত উদাহরণ হয়ে থাকলো এই আস্ফালন। প্রেমের ছাঁকনিতে যে কোনও জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ধরা পড়ে না, তা মনে করিয়ে দিয়ে তিস্তা বলছেন, “আমি সবসময়ই বিশ্বাস করতাম প্রেমের কোনও ধর্ম নেই, এবং আমি আর দীপন সেটা প্রমাণ করে দেখিয়েছি।“