কথায় আছে ‘শরীরের নাম মহাশয়’ - এটা কিন্তু বাস্তব। আজ মানুষের জীবন ও স্বাচ্ছন্দ্য এমন স্তরে পৌঁছেছে,তার জন্য অবশ্যই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার ( অসহনীয়) ভূমিকা কম নয়। আর তার জন্য বৈদ্যুতিক পাখা, এয়ার কন্ডিশন , কুলার ইত্যাদি ঘর ঠান্ডা রাখার উপায় বেরিয়েছে।একটা সময় কিন্তু এইসব ছিল না। বৈদ্যুতিক ফ্যান বা পাখাই ছিল না , তার মানে গরম ছিল না এমন নয়। তখন নিয়োগ হতো ‘পাঙ্খা পুলার’ , সরকারি অফিসে সাহেবদের মাথার উপর এক বিশাল কাপড়ের পাখা থাকতো যার সাথে লাগানো দড়ি টানতো বাইরে থেকে পাঙ্খা পুলার। কিন্তু তাতে কি এমন জোর!! তা বৈদ্যুতিক পাখার থেকে দুর্বল। তাই আসে বৈদ্যুতিক পাখা - কাজ হারায় ওই কর্মীর দল। এবার আসি কলকাতার প্রথম দেশীয় বৈদ্যুতিক পাখা কোম্পানির কথায় - যা কিন্তু বিদেশী কোম্পানিগুলোর তৎকালে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর সেটিও নির্মান করেছিলেন এক স্বাধীনতা সংগ্রামী। কে তিনি ? আর কোথায় এই কোম্পানি ? জানাবো আজ সেই ইতিবৃত্ত।
এককথায় বললে বলা চলে নতুন হাওয়া তৈরির কারিগর তিনি। নাম ক্ষীরোদবিহারী চক্রবর্তী।এ শহরে প্রথমে হাওয়ার জন্যই পাংখাকুলি নিয়োগ হতো। তাপমাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে অচল হয়ে পড়ে । আর সেই সময় দেশের মানুষকে তাদের আয়ত্ত্বের মধ্যেই ঠান্ডা হওয়ার স্বাদ আস্বাদন করিয়ে একেবারে তাজ্জব করে দিয়েছিলেন ক্ষীরোদবিহারী। হাতে টেনে নয় – সুইচ দিলেই বিদ্যুতে সেই হাওয়া চলত শনশোনিয়ে । তাতে জন্ম হয়েছিল ক্লাইড কোম্পানি। বাঙালির তৈরি কলকাতার প্রথম বৈদ্যুতিক পাখার কোম্পানি।
জায়গাটি কিন্তু বেশ পরিচিত। কলকাতার এলিট সিনেমা। তারই পাশে হিন্দুস্থান ইন্সিওরেন্স কোম্পানির বিশাল অফিস। আর তারই এক কোণে ছিল ‘ক্লাইড এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড’।১৯১৯ সালে এই কোম্পানির তৈরি ফ্যান প্রথম হাওয়া এনেছিল কলকাতায়। ক্ষীরোদবিহারীকে এই কোম্পানি গড়তে সাহায্য করেছিলেন ময়মনসিংহের মহারাজা রাজেন্দ্রকিশোর, পাইকপাড়ার কুমার অরুণ সিংহ প্রমুখ ধনী ব্যক্তিরা। ক্ষীরোদবিহারী ছিলেন আজন্ম ব্রিটিশ-বিরোধী। পূর্ব বাংলার নারায়ণগঞ্জের বন্দর গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি।জলপাইগুড়িতে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে উচ্চশিক্ষা লাভ করার সময় তাঁর সেই কার্যকলাপ আরো দৃঢ় হয়। পুলিশ ধাওয়া করা শুরু করে। অগত্যা দেশ ছেড়ে পালান তিনি। একটি কার্গো জাহাজে পে-মাস্টারের চাকরি নেন। সেখানে ইলেকট্রিকের কারিগরদের থেকেই ওয়ারিং, ফ্যান মেরামতি ইত্যাদি কাজ শিখে সঞ্চিত অর্থে কলকাতা ফিরে ১৯১৮-তে ইলেকট্রিক ফ্যানের কারখানা নির্মাণ করেন।
ক্লাইড কোম্পানি অন্যান্য বিদেশি কোম্পানিকে বেশ বিপাকে ফেলে দেয়। চাহিদা ও উৎপাদনের বৃদ্ধির সাথে বকুল বাগান রোডে তৈরি হয় অ্যাপ্রেনটিস ট্রেনিং স্কুল। ছেলেরা তো ট্রেনিং নিতই পরবর্তীতে মেয়েরাও সূক্ষ্মকাজ শিখে ফেলতে থাকে। বাঙালি যুবকের তৈরি স্বদেশি যুগের হাওয়ায় তখন দেশবাসী মজে। কিন্তু পরপর যুদ্ধ, অর্থনৈতিক অবক্ষয় ছাপ ফেলে ক্লাইড কোম্পানিতে। দেনার দায়ে কোম্পানি বিক্রি হয়ে যায়।
কিন্তু সংগ্রামী মানসিকতা এতো সহজে ভাঙার নয়। তাই ১৯৩২ সালে তিনি হিন্দুস্তান পার্কের একটি জমিতে তৈরি করেন নিজস্ব ফ্যান তৈরির কারখানা-‘ক্যালকাটা ফ্যান।অনেক ঝড়ঝাপটার পরেও ক্যালকাটা ফ্যান চলেছিল ঢের ঢের বছর।
চিরস্থায়ী কিছুই নয়,এই কোম্পানির আয়ুও ফুরোয়।কিন্তু ক্ষীরোদবিহারির নিরলস প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় ফ্যান কোম্পানির বিশাল বাজারে তার দেশীয় কোম্পানী স্বমহিমায় টিকে ছিল যেভাবে তা শেখার মতোই।বাংলাকে নতুন আলো দেখিয়েছিলেন তিনি। আর তাই এই নামটির এক মাহাত্ম আছে বই কি !