ক্যানভাস বলতে ঘরের মেঝে। দৈনন্দিন জীবনে, বাড়ির অন্দরে যে সব জিনিস পাওয়া যায় দিয়েই সেজে ওঠে শূন্যস্থান। অবহেলার দেওয়াল কিংবা প্রাণহীন মেঝে। ধুলো ঢাকা কার্পেটের আড়াল থেকে বেরিয়ে তারা হয়ে ওঠে জীবন্ত ক্যানভাস। প্রাণ পায় আলপনার দাগে।
আগের দিন রাত থেকে ভিজিয়ে রাখা আলোচাল পরদিন শিল নোড়ায় বেটে তৈরি করা হয় আলপনার পিটালি। মধ্যমা এবং অনামিকার ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে মাছ, পান, পাখি, পদ্মলতা, শঙ্খলতা, ধানের ছড়া, লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন। ক্যানভাস কখনও উঠোন, মেঝে, বাড়ির নিকানো দেওয়াল।
অনেক সময় আঙুলের পরিবর্তে কাপড় অথবা পাটের টুকরো। পাখি, মাছ, পদ্ম লতাপাতার মতো প্রাকৃতিক মোটিভ ছাড়াও জ্যামিতিক চিহ্নকেও অলংকরণে ব্যবহার করা হয়।
আলপনার রং সাধারণত সাদা। তবে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহারও করা হয়। সিঁদুর, বাটা হলুদ মিশিয়ে দেওয়া হয় ভিন্ন রূপ। আলপনা আসলে প্রতীক। বলা যায়, প্রতীকের সমাহার। দেবী পুজোর বেদীতে মঙ্গলঘটকে কেন্দ্র করে আঁকা হয় গোলাকৃতি আলপনা। যা আসলে পৃথিবীর প্রতীক। বাংলার প্রকৃতি ধরা দেয় চিহ্ন রূপে।
আলপনা কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘মাঙ্গল্য চিত্র’। সংস্কৃত আলিম্পন-শব্দজাত বলেও মনে করা হয়।
ভারতীয় তথা বাংলার নকশার বিবর্তন ঘটেছে নানা সময়ে। মুখ্যত ধর্মীয় অনুষঙ্গ। বিয়ে-শাদি, অন্নপ্রাশন, উপনয়নের মতো লৌকিক অনুষ্ঠান, পুজো, এবং প্রতিদিনের জীবনে আলপনা দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্মের নানা প্রতীক চিহ্ন আঁকা হয় আলপনার শরীরে। ব্রত কথার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে আলপনা। তবে পরবর্তী সময়ে ইসলামিক মিনাকারি মোটিভও মিশেছিল হিন্দু আলপনায়।
রেখা, বিন্দু মিলিয়ে মিলিয়ে, আঙ্গুলের সূক্ষতায় অপূর্ব সৌষ্ঠব। আলপনা আসলে গৃহশিল্প। পুজোর বেদি বা অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকা হয় গৃহস্থের সমৃদ্ধির জন্য। ক্ষণস্থায়ী তার স্থায়ীত্ব। বাংলার সহজ- সরল জীবন চরিত্রের একটা দিক সব সময়ে ধরা চেষ্টা থাকে আলপনায়। খুব জটিল কোনও শৈল্পিক বোধ বা আঙ্গিক সেখানে থাকে না। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটেছে। বাংলা আলপনায় বড় পরিবর্তন আসে শান্তিনিকেতনের প্রভাবে।
শান্তিনিকেতনে আলপনা চর্চার ধারা শুরু হয় কিছুটা সুকুমারী দেবীর সূত্রে। ১৯২৪ সালে পূর্ব-বাংলা থেকে তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন আলপনা শিল্পী। পরবর্তী সময়ে নন্দলাল বসূ এই ধারাকে আরও পুষ্ট করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় বর্ষামঙ্গল, জলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ, বসন্তোৎসব, পৌষ উৎসব, মাঘ উৎসবে আলপনার রেখায় ভরে উঠতে থাকে আশ্রমের ভূমি। আলপনা হয়ে উঠল ‘অলংকরণ শিল্প’। পুজোর বেদি আর অঙ্গনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মঞ্চ সজ্জা এবং অন্যান্য শিল্প মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছিল। শান্তিনিকেতনের আলপনা সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরীদেবী ও যমুনাদেবীর।
পুজো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আলপনার থেকে কিছুটা আলাদা আবার বিয়ের আলপনা। খড়িমাটি, গেরি মাটির চেনা মাধ্যম থেকে সে আলপনা বহু বর্ণের ছটায় রঙিন। গোলাপী, হলুদ, সবুজ কারুকাজের মধ্যে ময়ূর বা প্রজাপতির মোটিফ। বিবাহ প্রাঙ্গণ ছাড়াও পিঁড়িতে দেওয়া হত আলপনা।
এখন আলপনা তার প্রচলিত ছক থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক। ট্র্যাডিশনাল মোটিফের সঙ্গে মিশেছে প্রাদেশিক মোটিফও।