বাঙালির নিজের পরিচালক তরুণ মজুমদার

শিমুল-পলাশ-শালুক ফোটে তাঁর ছবিতে, শিউলি-ছাতিমের এক রাস সুবাস সুরভিত হয় তাঁর ছবি দেখলে। নব্বইতেও তিনি চিরতরুণ, অন্তত তাঁর ছবি দেখলে এমনটাই মনে হয়। তারণ্যে ভরা শ্যামল সবুজ পল্লীবাংলা ধরা দেয় তাঁর ছবিতে। তাঁর নিজের কথায়, তিনি তাঁর সব ছবিতে একটা আশার আলো দিতে চেষ্টা করেছেন।

তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই সাহিত্যনির্ভর ছবি, সেটা ভালবাসার বাড়ি হোক বা দাদার কীর্তি, গণদেবতামৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, তাপস পাল, দেবশ্রী রায়ের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, তাঁর হাত ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছেন

১৯৩১ সালের আজকের দিনেই, অবিভক্ত বাংলার বগুড়ায় তরুণ মজুমদারের জন্ম হয়েছিল। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে সেখানেই, পরে সেই ছোট্ট শহরের সাধারণ একটা ছেলে, সাধারণ মানুষের গল্প বলতে শুরু করলেন। যা অসাধারণ হয়ে ধরা দিল রুপোলি পর্দায়।

নিজের মতো খুব সাধারণ ছবিই বানাতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি যেখানে থাকেতন বগুড়াতে, সেই সময় সেখানে দুটো সিনেমা হল ছিল। তাঁর কথাতেই উঠে এসেছে, ওখানে নিউ থিয়েটার্সের অথবা বোম্বে টকিজের ছবি যেত। ইংরেজি ছবি তো বেছে বেছে আসত, যেমন চার্লি চ্যাপলিনের ছবি ইত্যাদি। তিনি সেসব দেখতেন, চ্যাপলিনের দ্বারা অনুপ্রাণিতও হয়েছিলেন।

 

TarunMajumdar1

 

তাঁর বাড়ি থেকে ছবি দেখায় কোনদিন বাধা দেওয়া হয়নি। পারিবারিক আর্থিক অবস্থার কারণে হয়ত নিয়মিত ছবি দেখতে পারতেন না, কিন্তু ছবির প্রতি ছোটবেলা থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল। ছবি দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত জিনিস করতেন তিনি, অন্ধকার হলে যখন পর্দায় ছবি দেখতেন, তখন অজান্তেই ছবির পাত্রপাত্রীদের নিয়ে মনে মনে অন্য একটা গল্প বুনতে শুরু করতেন। অনেকক্ষণ পরে তাঁর খেয়াল হত, তিনি তো মূল ছবিতে থেকে সরে গিয়েছেন। পুরো গল্পটাই নিজের মতো করে ভাবছেন। ছবির প্রতি এমনই ছিল তাঁর আকর্ষণ, ছবি দেখার শখ, তাঁকে টেনে নিয়ে গেল ছবির দুনিয়ায়।

ম্যাট্রিকুলেশনের পরে দেশভাগের পর চোদ্দো বছর বয়সে চলে আসেন এপার বাংলায়স্কলারশিপও পেয়েছিলেন, বরাবরই বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছে ছিল। সেন্ট পলস কলেজে ভর্তি হন, সেখানকার হোস্টেলেই থাকতে শুরু করলেন। তাঁর বাবা-মা তখন উত্তর কলকাতার গ্যালিফ স্ট্রিট অঞ্চলে থাকতেন।

সেন্ট পলসে আইএসসি পর্যন্ত পড়ার পরে, স্কটিশ চার্চ থেকে রসায়নে স্নাতক হয়েছিলেন পরিচালক। আসলে ফিল্মের নেশাটা ছিলই। কলকাতায় আসার পরে যা জাঁকিয়ে বসল। ফিল্ম লিটারেচার সেসময় পাওয়া যেত না, ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনও স্তিমিত। সময়টা পাঁচের দশক, শুনতে পেলেন, মেট্রো সিনেমার গলিতে সাইক্লোস্টাইল করা স্ক্রিপ্ট চার আনায় বিক্রি করা হয়।

তিনিও গেলেন, দেখলেন রাস্তার ধারে কিছু মুসলমান স্ক্রিপ্ট বিক্রি করছে। সে সময় মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের যেসব ছবি আসত, তাদের সঙ্গে এক কপি করে সাইক্লোস্টাইল স্ক্রিপ্ট পাঠানো হত সেন্সরের জন্য। সেন্সর হয়ে যাওয়ার পর ছবি রিলিজ হয়ে গেল, ওইগুলোই বিক্রি হত, এইভাবেই ক্রমাগত আগ্রহ বাড়তে লাগল। স্ক্রিপ্টের স্ট্রাকচার সম্পর্কে ধারণা জন্মাতে শুরু করল। একটা স্ক্রিপ্টে কী কী হয়, কী কী থাকে ইত্যাদি। পড়াশোনা শেষ হয়ে যেতেই বড়মামাকে বলেছিলেন, তিনি ফিল্ম লাইনে যোগ দিতে চান।

 

TarunMajumdar2

 

তিনিই হয়ে উঠলেন বাঙালির প্রাণের চলচ্চিত্রগুলির নির্মাতা তরুণ মজুমদার। গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্র পরিচালনা করে আসছেন। তিনি তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মূলত বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। তাঁর অনেকগুলি চলচ্চিত্রই সাহিত্য-নির্ভর। তিনি বিমল কর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকীর্তি বড়পর্দায় তুলে ধরেছেন। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রে অনেক সময়েই রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার থাকে। তিনি তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য চলচ্চিত্রকার যেমন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ প্রমুখ পরিচালকদের তিনি নিজের মতো করে উজ্জ্বল। নিয়মিত ভাবে বক্স অফিস হিট ছবি নির্মাণ করে চলেছেন।

সাদা-কালো থেকে রঙিন সর্বত্র তিনি বিরাজমান। বাড়িতে বাড়িতে টিভি আসতে শুরু করেছে, পরিবারের সবাই মিলে দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ম্যাটিনি শো। পাড়ার লোক আসছেন, উপচে পড়ছে ভিড়। আট থেকে আশি সবাই তখন বাংলা সিনেমা দেখছেন। যাঁদের সিনেমা বাঙালি নিয়মিত দেখতে, তাঁদের মধ্যে তরুণ মজুমদারের নাম সবার আগে উঠে আসবে। তিনি বাঙালির পরিচালক তরুণ মজুমদার। তাঁর স্ক্রিপ্ট পরিবারকে এক করে রাখার অনুপ্রেরণা জাগায়, সপরিবারে তাঁর ছবি দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার ঘর থেকে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল যৌথ পরিবারের। তখন তিনি যেন বেঁধে রাখার গল্প বলতেন, তাঁর ছবি পরিবার মানে কেবল নিজের বাড়ি নয়। গোটা গ্রাম-পাড়া নিয়েই বৃহত্তর পরিবারের গল্প বলতেন তিনি। ফেলে আসা সময়ের হাতছানি, চিরকালীন তাঁর আধুনিকতা, তাঁর আধুনিকতা ইউনিভার্সাল।

 

TarunMajumdar3

 

বাঙালির খুব চেনা রং, গন্ধ, পরিবেশ, মানুষদের সঙ্গে নিয়ে কাটিয়ে দিলেন পাঁচ যুগ। বাংলার সিনে-দর্শক কখনোই তাঁকে বর্জন করতে পারলেন না। চেয়েছিলেন বাংলার ঘরে ঢুকে সেই ঘরের মানুষদের কথাই বলবেন। তিনি পেরেছেন। এখনও পর্যন্ত তাঁর শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ভালোবাসার বাড়িতেও তাঁর ঘরানা অক্ষত। কোনদিন অযথা খ্যাতি বা প্রচারের আলোয় ছোটেননি। বড় বড় ফিল্মি পার্টি চিরকাল এড়িয়ে গিয়েছেন, টিভিতে বাইট তেমন দেন না। ২০১৪ সালে প্রথম ধারাবাহিক তৈরি করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দুর্গেশনন্দিনী'। সেই ধারাবাহিকেও তাঁর ধারা অক্ষত, গল্প যেখানে শেষ তো ধারাবাহিকও শেষ।

জীবনের প্রথম দিকের ছবি বানিয়েছিলেন, তিনি ও তাঁর দুই বন্ধু মিলে, যৌথভাবে যাত্রিক নামে ছবিগুলো পরিচালনা করেছিলেন। যাত্রিকে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দিলীপ মুখোপাধ্যায় আর শচীন মুখোপাধ্যায়

১৯৫৯-এ উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত চাওয়া পাওয়া তরুণ মজুমদারদেরর প্রথম পরিচালিত ছবি। ১৯৬০-এ যাত্রিক-এর তৈরি স্মৃতিটুকু থাক-এ সুচিত্রা দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬৩-তে যাত্রিক আরও দু'টি হিট ছবি উপহার দেয় – পলাতক ও কাঁচের স্বর্গ। কাঁচের স্বর্গ জাতীয় পুরস্কার পায়। ১৯৬৫ সাল থেকে তরুণবাবু নিজে সিনেমা পরিচালনা শুরু করেন, তাঁর ছবির নাম ছিল আলোর পিপাসা।

 

TarunMajumdar4

 

এর মাঝেই অন্য একটা ঘরানার জন্ম, যা দর্শকদের হৃদয়ের কাছের,নিজেদের গল্প অথচ নিছক বিনোদন নয়- এমন সারল্যে ভরা গল্প বলতে চাইলেন তরুণ মজুমদার। একটুকু বাসা, পলাতক, বালিকা বধূ, আগমন, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, কুহেলী, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসা, আপন আমার আপন, পথ ভোলা, পথ ও প্রসাদ, আলো, চাঁদের বাড়ি, ভালোবাসার অনেক নাম, বক্সঅফিস কখনও মুখ ফেরায়নি। বাংলা সাহিত্যকে বুকে করে বেঁচে ছিলেন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানিয়েছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ছিল তাঁর অন্তরে। সেইসময় বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির 'হিট' পরিচালক বললে তিনিই।

সাহিত্যের গল্প কখনও একটু বদলেছেন, তাও আপন হয়ে উঠেছে। দাদার কীর্তিতে কেদার চরিত্রটা আসলে ছিল উপরচালাক ধরনের, তা বদলেছেন। অনুপ কুমারকে নিয়ে বানালেন পলাতক, গল্পটা যেখানে শেষ, সেখানে তাঁর ছবির ইন্টারভ্যাল। তার পর পুরোটা বাড়ানো। 'বালিকা বধূ'র চিত্রনাট্য শুনে চিফ টেকনিশিয়ানদের অনেকেই বলেছিল, 'কী আছে এর মধ্যে?' একটা তেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে সতেরো বছরের ছেলের বিয়ে, মেয়েটি শুধু বাপের বাড়ি চলে যেতে চায়।

কিন্তু এর মধ্যে এমন একটা মাধুর্য ছিল, যা নিয়ে ছবি হতে পারে। তাঁর আর্ট ডিরেক্টর বংশী চন্দ্রগুপ্ত বলেছিলেন, 'আপনি যদি এই ছবিটা না করেন, জীবনে আপনার সঙ্গে ছবি করব না।' আবার 'সংসার সীমান্তে' গল্পটির শেষে ছিল অসীম হতাশা। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, শেষে মানুষের বেঁচে থাকার খোরাক রেখে যাবেন। তাই করলেন। এক দৈনিকে প্রচেত গুপ্তর 'ভালবাসার বাড়ি' গল্পটা পড়ে ভাল লাগায়, ২০১৮তে সেটা নিয়ে ছবি বানালেম। ওটাই তাঁর এখন অবধি শেষ কাজ।

চাঁদের পাহাড় করার কথা ভেবেছিলেন, তা হয়নি। উত্তমকুমারের সঙ্গেও আরেকটা ছবি করার কথা হয়েছিল, টিনের তলোয়ার। উত্তমই ইন্টারেস্টেড ছিলেন, বীরকৃষ্ণদার চরিত্রটি করতে চেয়েছিলেন। স্ক্রিপ্ট তৈরি হচ্ছিল, দুর্ভাগ্যবশত উত্তমকুমার সেই সময়ই চলে যান।

 

TarunMajumdar5

 

গল্প ছাড়াও তরুণ মজুমদারের ছবিতে গান একটা বড় ভূমিকা পালন করে, রবীন্দ্র সংগীতের এক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ থাকত। 'কাঁচের স্বর্গ ' ছবিতে প্রথম রবীন্দ্র সংগীত ব্যবহার করেছিলেন। দর্শক গানগুলো নিয়েছেন। গান তাঁর ছবিতে চিত্রনাট্যের অংশ হিসেবে আসে। ছবিতে ফোক, অতুলপ্রসাদ, ডি এল রায়, মুকুল দত্তের গান ব্যবহার করেছেন। হেমন্তের সঙ্গে পঁচিশ বছর কাজ করেছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উপরেই তাঁর ছবির গানের দায়িত্ব থাকত।

চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি বি.এফ.জে.এ. সম্মান, পাঁচটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার ও একটি আনন্দলোক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৯০ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়।

তাঁর ছবি বিপুল বিস্তৃত এক আকাশ, যা এক করে বেঁধে রাখে আমাদের। বারবার ঘরে ফেরার গান তাঁর ছবিতে ভরপুর, ঘরে মানে পুরোনোদিনে ফেরা, যৌথ পরিবারে ফেরা। শিকড়ের সুলুক সন্ধান। শাপলা শালুকের পুকুর, শালিক চড়ুই, নারকেল গাছের সারি, বাঁশবন। মাঝে মাঝে রোদ ঢুকছে, মাঝে মাঝে ছায়া আলো আঁধারির খেলা। খোড়া চালের বসতবাড়ির মাঝে মাঝে টিনের চাল। মাচায় লাউ ঝুলছে। তাঁর ছবি  বাংলার নানান রঙের পল্লীগ্রামের আত্মরূপ দর্শন করা। বাতাসপুর, খণ্ডগ্রাম, বাতিকর, পলাশবুনি, কীর্ণাহার, মন্দিরা, খয়রাশোল

অতি সরল, স্নিগ্ধ, ভেজামাটির গন্ধমাখা ছবি করেছেন তিনি। মানবহৃদয়ের জটিল গহন অন্ধকারে আলো ফেলেছেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অসংখ্য সফল ছবি তৈরি করে বাংলা ছায়াছবিকে ঋদ্ধ করেছেন। আসমান-জমিন আমার পল্লী গ্রাম, আলপথ, মেঠোফুল ভাল থাকুক তরুণ মজুমদারের ছবিতে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...