সাদা ধুতি-শার্টের এক বাঙালি। গান গাওয়ার সময় কোন বিকট অভিব্যক্তি নেই। লাফ ঝাঁপ নেই, কেবল হারমোনিয়াম বাজিয়ে চলা। আর তাতেই মুগ্ধ তামাম দুনিয়া। আজও এর ব্যতিক্রম হয় না। তিনি হতে চেয়েছিলেন সাহিত্যিক। ভেবে বসেছিলেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন। গল্প লিখতেন। তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল। তখন সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে তিনি মশগুল। দেশ পত্রিকায় একবার গপ্পোও ছাপা হয়েছিল 'একটি দিন'। কিন্তু ভাগ্য তাঁর জন্য অন্য ইতিহাস লিখে রেখেছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হওয়া হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকে পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে হয়েছিল। তদানিন্তন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট আধুনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঁচ সন্তানের জনক কালিদাস মুখোপাধ্যায়। চার ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান হেমন্তকে নিয়ে ছোট থেকেই বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের উচ্চাআশা ছিলই। চোদ্দ পুরুষের ভিটে বড়ুগ্রাম ছেড়ে কালিদাস পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন ভবানীপুরের ২৬/২এ রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। দুকামড়ার বাড়ি। ম্যাকনিন ম্যাকেনজির সাধারণ কেরানি কালিদাস। টানাটানির সংসার। মিত্র ইনস্টিটিউশনের মতো বেশি মাইনের স্কুলে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কিন্তু মেজ ছেলের পড়াশুনোয় আগ্রহ দেখে হেডমাস্টারমশাইকে ধরেটরে হাফফিতে কোনক্রমে ভর্তি করেছিলেন।
ছেলে পড়াশুনোয় ভালই, কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষার ঠিক তিন মাস আগে বিপত্তির শুরু। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে! তার মূলেও কিন্তু ওই গান! টিফিন টাইমে অন্যরা সব খায়দায়। কালিদাসবাবুর মেজছেলের না আছে বাড়ির দেওয়া টিফিন, না পকেটে কানাকড়ি। বন্ধুদের নিয়ে সে টেবিল বাজিয়ে গান গায়। পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মনের রেকর্ডের গান। তাতে এমন হইচই, হট্টগোল খাতা থেকে নাম কেটে দেওয়া হল।
ফাইনাল পরীক্ষার বাকি তখন মাত্র তিন মাস। কালিদাসবাবু স্কুলে গিয়ে প্রায় হাতে পায়ে ধরে সেযাত্রায় ছেলেকে রক্ষা করেন। এর পরও যখন ফার্স্ট ডিভিশন পেল ছেলে, চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু তত দিনে গান জাঁকিয়ে বসেছে! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে শুয়ে সন্ধ্যার মেঘমালায় সুর খুঁজে পাওয়ার ব্যারামের জেরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হল না ধুতি-শার্টের! তবে, ইঞ্জিনিয়ারিং শেখেননি তিনি, বলা যায় না! সঙ্গীতের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, রসায়নে দীক্ষিত হলেন কার্যত আত্মশিক্ষায়। গাইতে শুরু করেই সুর তৈরির নেশায় পড়লেন। এখানেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ইতি টানলেন।
বন্ধু সুভাষ-অসিতবরণকে ধরে রেডিওয় অডিশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। অভিনেতা অসিতবরণ তখন রেডিয়োয় তবলা বাজান।
অডিশনে পাশ করার তিন মাস বাদে প্রোগ্রামের চিঠি এল। পঙ্কজ মল্লিক এক দিন আকাশবাণীতে অনুজ হেমন্তকে দেখে বললেন, 'তুমি তো দেখছি আমাদের ভাত মারবে!'কিংবদন্তি পঙ্কজ কুমার মল্লিককে গুরু মানতেন হেমন্ত। হেমন্তের গানে পঙ্কজ মল্লিকের প্রভাব এতটাই ছিলে যে তাঁকে ছোট পঙ্কজ বলেও ডাকা হত। ইঞ্জিনিয়ারিংটা আর হল না। বাবা দুঃখ পেয়েছিলেন, তবুও ১৯৩৮ সালে কলেজে ইস্তফা দিয়ে বসল ছেলে।
এই সময়কাল, তার অল্প আগে পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের জীবনে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকল। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় উৎসাহেই ১৯৩৫ সালে প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য গান রেকর্ড করেন হেমন্ত। গানটি ছিল, 'আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী'। ১৯৩৭ সালে প্রথম রেকর্ড 'কলম্বিয়া' থেকে মুক্তি পায়। গান দুটি ছিল, 'জানিতে যদি গো তুমি' এবং 'বলো গো বলো মোরে'। প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেটাকে কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে চেনাজানা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যাতে কারও কৌতূহল হয়, জানতে চান, ওটা কী! ধীরে ধীরে গান গাওয়া তখন অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়েছে। ১৯৪০ সালে 'নিমাই সন্ন্যাস' সিনেমায় গায়ক হিসেবে প্রথম কণ্ঠদান। হেমন্তের প্রথম হিন্দি গান ছিল 'কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে' এবং 'ও প্রীত নিভানেওয়ালি', যা কলাম্বিয়া থেকে ১৯৪০ মুক্তি পেয়েছিল। গান দুটির সুরকার ছিলে কমল দাশগুপ্ত, কথা লিখেছিলেন ফৈয়াজ হাশমি। ১৯৪৪-এ বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরল। রেডিয়ো থেকেও ঘন ঘন ডাক। 'মহালয়া'। আইপিটিএ। সলিল চৌধুরী। প্রথম প্লে-ব্যাক।
কিন্তু তারপরেও খুব সুদিন চলছিল তেমনটা নয়। অর্থের কারণেই বহুদিন পর্যন্ত গানের টিউশানি ছাড়তে পারেননি। বাঁধা রোজগারের জন্য গ্রামাফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে গানের ক্লাস নিতেন। বলতেন টিউশনি না করলে খাবেন কী? ১৯৪৫ সালে বিয়ে করলেন বেলা মুখোপাধ্যায়কে। স্ত্রী, পাঁচ-পাঁচটি নাবালক শ্যালক-শ্যালিকা নিয়ে নতুন সংসার পাতলেন ইন্দ্র রায় রোডের ভাড়া বাড়িতে। ১৯৪৭-এ প্রথম সন্তান, জয়ন্ত এবং ১৯৫৪-তে রাণুর জন্ম। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস। প্রায় চার দশক ধরে বাংলা হিন্দি সঙ্গীত দুনিয়ায় রাজত্ব করে ছিলেন হেমন্ত।
কলকাতায় ফেরার ট্রেনের টিকিট কেটে মুম্বই থেকে পালিয়ে আসছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁকে আটকান ফিল্মিস্তান স্টুডিওর তখনকার সর্বেসর্বা প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। —''আমি তোমাকে এখানে এনেছি। তুমি চলে গেলে, তুমি তো হারবে না, আমি হেরে যাব। একটা হিট ছবি দিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও। আমি বাধা দেব না।'' শশধর মুখোপাধ্যায়। পরিচালক হেমেন গুপ্তকে দিয়ে 'আনন্দমঠ' ছবির জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে মুম্বইতে নিয়ে যান তিনি। ফিল্মিস্তানের সঙ্গে তখন লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক খারাপ। তবু তাঁকে দিয়ে ছবির জন্য 'বন্দেমাতরম' গাইয়ে প্রায় অসাধ্যসাধন করেছিলেন হেমন্ত। নিজে গেয়েছিলেন 'জয় জগদীশ হরে'। গীতা দত্তের সঙ্গে ডুয়েট। গান তো জনপ্রিয় হল, কিন্তু ছবি? সুপার ফ্লপ। তার পরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে আসতে চান কলকাতা। ভিটি স্টেশন থেকে লুকিয়ে ফোন করে সে-খবর শশধর মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছে দেন হেমন্তের স্ত্রী বেলা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ফেরা হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি! এর পরই যে 'নাগিন'! যে ছবির গানের রেকর্ড কুড়ি বছর বাদে ভেঙেছিল 'ববি'।অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই কিনা এক সময় রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়েও ঠায় চার ঘণ্টা বসে থেকে শুনেছেন, 'দূর মশাই, দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন! আপনার গান কে শুনবে? গান শুনে বাড়ি চলে যান।' দিল্লির এক জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে মুগ্ধ উস্তাদজি বলেছিলেন, ''তোমার গান শুনছিলাম এতক্ষণ।''
আর গজল-শাহেনশা মেহদি হাসান বলতেন, ''দেখা হলে লতাজির কণ্ঠে একটা চুমু দিতে চাই।'' আর পুরুষ-কণ্ঠ হলে?— ''হেমন্তকুমারের। এই উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠস্বর হেমন্তকুমারের।'' ওই সেই বাঙালি ধুতি-শার্ট।
এত নতুন গায়ক, এত নতুন ধাঁচের রচনা ও সুর, কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ কেন এখনও অদ্বিতীয়। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল কতকগুলি আপাতবিরোধী উপাদানের বিরল সমাবেশ। এক দিকে ঘনীভূত অন্তর্মুখী বিষাদ ও নিরাসক্তি, সূক্ষ্ম সানুনাসিকতার আভাসে যা পেত এক চাপা অভিমানের সুর। অন্য দিকে, এই নিরাসক্তি তারুণ্যে ভরপুর, দৈনন্দিনতার ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত নয়। এ যেন এক চিরন্তন তরুণ বিবাগি। মুক্ত উদাত্ত প্রসারিত কণ্ঠ, আর একটা ঝোঁক তাঁকে ঠেলে দিত বিপরীতে, অন্তর্মুখী রহস্যে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে একচ্ছত্র নায়ক। তাঁর কণ্ঠের স্বাভাবিক মার্জনা। অমোঘ সত্যই তাঁর গানের সম্পদ।
সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তাঁর পরিসর অসীম। আবহসঙ্গীতে নিস্তব্ধতা ঘনীভূত হয়। এক রহস্যময় অন্তিমে, তা থেকেই উঠে আসে সুরের মৃদু গুঞ্জন, আরও কিছু সুর ও কথা, কিছুক্ষণ পরেই সুরধ্বনি মিলিয়ে যায় আবহসঙ্গীতের অমোঘ কালধ্বনিতে। এ যেন গান নয়, শূন্যতা থেকে উঠে আসা এক হালকা বাতাসের আমেজ, যা ফের মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। হেমন্তের কণ্ঠে আমরা উচ্ছ্বসিত বা উল্লসিত হই না। মুগ্ধ হই, বিষণ্ণ, বিস্মিত হই। এই বিস্ময় সদা বিপন্ন, তাঁর কণ্ঠস্বর যে বড় স্পর্শকাতর, সর্বদাই ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা। তাঁর কণ্ঠে মিশে থাকত সূক্ষ্ম ভারসাম্য ধরে রাখার আকুতি, তাঁর সম্মোহনী আকর্ষণ।
আজ ভারতীয় সঙ্গীতজগতের সেই কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ১০২তম জন্মদিন।