হালকা আলোয় বোঝা যায় ঘন অন্ধকার। মধ্যরাত্রি। টুপ টুপ শব্দে গুপির ঘুম ভেঙ্গে যায়। এতো রাতে এই ধরণের শব্দে ভয় এবং অবাক হওয়ার কথা। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে একটি ঢাক রাখা আছে। তার উপর জল পড়ায় এই শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। গুপিকে দেখে বাঘাও ভয়ে জেগে ওঠে। তারপরের দৃশ্য আমরা সবাই জানি। ভুতের রাজার বরে একজন সুগায়ক আরেকজন ভালো ঢাক শিল্পী হয়ে ওঠেন।
ঢাকের বোলে এক অদ্ভুত মাদকতা রয়েছে। শরতের নীলাকাশ, কাশফুল আর ঢাকের তাল বুঝিয়ে দেয় শারদীয়া সমাগত। ঢাক ছাড়া দুর্গাপুজো বাঙালি ভাবতেই পারে না। বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকা তিলোত্তমায় পুজোর কিছুদিন আগে কাশফুল দিয়ে সাজানো ঢাক নিয়ে হাজির হয় ঢাক শিল্পীরা। বাঙালির কাছে এ ভীষণ আবেগের জায়গা।
ঢাক দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড়ো আকারের মেমব্রোফোন যন্ত্র। আকার নলাকার। তবে ব্যারেলের চেয়ে পৃথক। আম কাঠ দিয়ে ঢাকের খোল তৈরি করা হয়। খোলের দুদিকে চামড়ার ছাউনি দেওয়া হয়। ঢাকের মুখের ব্যাসের পরিমাণ প্রায় দেড় হাত হয়। একদিকের মুখ পুরু চামড়া আর অন্যদিকের মুখের চামড়া অপেক্ষাকৃত পাতলা হয়।
সাধারণত ছাগলের চামড়া দিয়ে ঢাক তৈরি করা হয়। কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তাতে বেশ পরিমাণ লবণ ছিটিয়ে সাত থেকে আটদিন ভিজিয়ে রাখা হয়। চামড়া থেকে পশম উঠে গেলে ভালোভাবে পরিষ্কার করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে টান টান করে রোদে শুকানো হয়। তারপর সেই শুকনো চামড়াকে সাইজ মতো কেটে এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়।
বাংলার ঢাকের নানান নাম। "ঢাক", "জয়ঢাক", "বীরঢাক" ইত্যাদি। আওয়াজ ও আকৃতি অনুসারে তারতম্য হয়ে থাকে। ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সুর এবং ছন্দ মূর্ছনা তৈরি করার জন্য প্রাচীন কাল থেকেই ঢোল ও বাঁশি বাজানো হয়। প্রাচীনকালে ঢাক ডঙ্কা নামে পরিচিত ছিল। তবে সেই সময় ডঙ্কা জালা আকৃতির মাটির পাত্র দিয়ে তৈরি হত।
ঢাকের বোলে বেশ কঠিন ও জটিল। বিভিন্ন উৎসব ও তার বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ তালে ঢাক বাজানো হয়। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজানো হয় দেবীর বোধনে, দেবীর ঘুম ভাঙাতে, দেবীর পূজাকালীন, দেবীর আরতিতে এবং দেবীর বিসর্জনে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকের বাজনার ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমানে সেই ভিন্নতা দেখা যায় না। ঢাকের বাজনা বংশ পরম্পরায় প্রচলিত। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জিত। অনেকেই এখন বংশ পরম্পরায় এই পেশায় না আশায় তা লুপ্ত হচ্ছে।
ঢাক শিল্পীরা বিশ্বাস করেন ঢাকের বোল দেবাদিদেব মহাদেবের সৃষ্টি। কথিত আছে দেবোত্তর যুগে পানিনি যে "অষ্টাধয়ী" ব্যকরণ রচনা করেছিলেন তা শিবের আশীর্বাদ। পানিনি হিমালয় গিয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। শিব নৃত্যের তালে চোদ্দবার ঢাক বাজান। প্রতিবার ঢাক বাজানোর সঙ্গে একটি করে নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি শব্দ বিভিন্ন বর্ণের সমষ্টি। তা পানিনির "অষ্টাধয়ী"তে স্থান পায়। ঢাকের শব্দ বা ছন্দ তালের প্রতীক।
বর্তমানে আম কাঠের ঢাকের বদলে লোহার ঢাক তৈরি হচ্ছে। আম কাঠের ঢাক খুব ভারী হয়। ফলে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর। এছাড়া দাম প্রায় ৭-৮ হাজারের মতো। লোহার তৈরি ঢাক তুলনায় হালকা এবং সস্তা। তাই শিল্পীরা সেই দিকে ঝুঁকছে।
লোহার পাতলা চাদর দিয়ে ঢাকের খোল তৈরি করে দুদিকে চামড়া দিয়ে এই ঢাক তৈরি হচ্ছে। এতে ঢাকের আওয়াজে সামান্য হলেও হেরফের হচ্ছে। তবে এ নিয়ে ঢাক শিল্পীরা খুব একটা চিন্তিত নন। তাঁদের মতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন অনিবার্য।