কালীকথা: এক প্রতিমায় মহামায়ার সঙ্গেই কালিকার আরাধনা

মহামায়ার পুজো মিটে গিয়েছে। তিনি ফিরে গিয়েছে কৈলাসে। এবার কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দেবী মহামায়ার আরেক রূপে আসতে চলেছেন। দশমী থেকেই শুরু হয় সেই প্রস্তুতি। যেমন শান্তিপুরের চাঁদুনি মায়ের পুজো, দুর্গাপুজোর দশমীর দিন থেকেই কালীপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় এই চাঁদুনীবাড়িতে। দশমীর দিন পরিবারের বয়ঃজেষ্ঠ্যা সদস্যা চাঁদুনীমায়ের গায়ে মাটি দেন তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় কালীপুজোর প্রস্তুতি। কিন্তু বঙ্গে দুর্গার সঙ্গেই চলে কালী আরাধনা। একই প্রতিমায় সেই আরাধনা করা হয়। প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে এদেশে দুর্গা দেবী আরাধনার সূত্রপাত। দেবী মূর্তির ইতিহাসও সুপ্রাচীন। সে সময় বাসন্তী দেবীর মূর্তি পূজিত হত। তারপর বহু সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, পুরাণের যুগে মহিষাসুরমর্দিনী রূপের আবির্ভাব ঘটেছিল। তারপর দশভূজা রূপের সৃষ্টি। অধুনা সপরিবারে পূজিতা হন দেবী।
 
দেবীর একই দেহে কালী, আবার একই দেহে দুর্গার অবস্থান, সেই প্রতিমাও পূজিত হয় বঙ্গে। ৪০০ বছর ধরে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী এই অর্ধকালী পুজো। পুজো আরম্ভ হয়েছিল বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে। এখন জলপাইগুড়ির ধূপগুড়িতে এই পুজো হয়। ভট্টাচার্যপাড়া সর্বজনীন পুজো হিসেবে এই পুজো পরিচিতি পেয়েছে। ওপার বাংলার শিলালোট গ্রামের বাসিন্দা দ্বিজদেব ভট্টাচার্য দেবীর বরলাভ করেছিলেন। তারপরই দ্বিজদেবের পরিবারে দেবীরূপী অর্ধকালীর জন্ম হয়। মেয়ের দেহের অর্ধেকাংশ শ্যামবর্ণের, আর বাকি অংশ বিপ্রবর্ণা অর্থাৎ ফর্সা। দ্বিজদেবের টোলের মেধাবী ছাত্র রাঘবানন্দ অর্ধকালীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। বিয়ের পর দ্বিজদেবের আপত্তি সত্ত্বেও রাঘবানন্দ স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার মানিকগঞ্জে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানেই শুরু হয় দেবীর পুজো, এই পুজোই অর্ধকালী বংশের দুর্গাপুজো হিসেবে পরিচিতি পায়।
 
এই পুজো ঘিরে এক কাহিনী শোনা যায়, কোনও এক নবমী তিথিতে দক্ষিণমুখী হরিৎবর্ণা দুর্গা প্রতিমার সামনে বসে চণ্ডীপাঠ করছিলেন পণ্ডিত রাঘবানন্দ। সে সময় শিক্ষা শেষে বাড়ি ফেরেন তাঁর পুত্র রামেশ্বর। বাবার চণ্ডীপাঠ পছন্দ না হওয়ায় চণ্ডীপাঠ শুরু করেন রামেশ্বর। রামেশ্বরের চণ্ডীপাঠে মৃন্ময়ী মূর্তিতে পঞ্চপ্রাণের সঞ্চার হয়। কিন্তু ছেলের পাঠের জেরে রাঘবানন্দ চণ্ডীপাঠে ভুল করে বসেন। ঘটে বিপত্তি, মৃন্ময়ী দেবীমূর্তি রক্তবর্ণ ধারণ করেন। দেবীর মুখ দক্ষিণ থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরে যায়। দেবীকে সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট হন অর্ধকালী। অন্যদিকে বাবা ছেলের লড়াই থামাতে দু-জনকে নিরস্ত করেন তিনি। এই ঘটনার কারণে অর্ধকালী ঘোষণা করেন, তাঁর বংশের পুজোয় কোনদিন চণ্ডীপাঠ হবে না। সেই নিয়ম আজও মানা হচ্ছে। অর্ধকালী বংশের সুকান্ত ভট্টাচার্য ধূপগুড়িতে এই পুজোর সূচনা করেন। ধূপগুড়িতেই নয়, বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে অর্ধকালী বংশের উত্তরপুরুষেরা আজও একই রীতিতে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামেও এমনই এক দেবী পূজিতা হন। দেবী দুর্গা ও দেবী কালিকা হলেন শক্তির দুই রূপ। মায়ের এই দুই রূপই একত্রে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামের দুর্গাবাড়িতে পূজিতা হয়ে আসছেন। ১৫৯ বছরের প্রাচীন পুজোতে দেবী অর্ধ কালী ও অর্ধ দুর্গারূপে পুজো পান। এই পুজোটিও ওপার বাংলা থেকেই শুরু হয়েছিল।
 
১৮৬৪ সালে ঢাকা বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডলের জাঁদরেল দারোগা হরিকিশোর ঘোষ একরাতে জগজ্জননী মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মায়ের নির্দেশেই পুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন হরিকিশোর ঘোষ। পুজোর তোড়জোড় শুরু হল, মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হল। মূর্তি তৈরির একেবারে শেষ লগ্নে পটুয়ারা হলুদ রঙ করা মাত্রই মূর্তির ডানদিকের অংশের রঙ কালো রঙে বদলে গেল। তখনই হরিকিশোরের মনে পড়ল তার স্বপ্নের দেবীমূর্তিও সাধারণ ছিলেন না। কূলপুরোহিত হরিকিশোর ঘোষকে দেবীকে অর্ধকালী অর্ধদুর্গা রূপ দিতে বললেন। সেই থেকে আজও মা এই রূপেই সুভাষগ্রামের ঘোষদের বাড়িতে পুজো পেয়ে আসছেন। দেশভাগের পর ঘোষ বংশ এপার বাংলায় চলে এসেছেন, তৈজস পত্র ও বলিদানের খড়গ আনা হয়েছে। ওপার বাংলার পুজো বেদির একমুঠো মাটি, এনে এখনকার পুজোর দালানে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। 
 
একচালার প্রতিমার দেহের মাঝ বরাবর ডানদিকে অমানিশারূপী দেবী কালিকা এবং বামদিকে তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দুর্গা। দশপ্রহরণ ধারিণী দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে আর বাম পা অসুরের স্কন্ধে স্থাপিত। মহিষাসুর দেবী কালিকার হস্তধৃত শূলে বিদ্ধ। দেবীর ডান ও বাম পাশে স্বর্ণবর্ণা লক্ষ্মী এবং শুভ্রবর্ণা সরস্বতী, চিরকুমার কার্তিক থাকেন দেবীর ডানপাশে, গনেশ বামদিকে। পুত্রকন্যাসহ জগন্মাতার এই রূপই হরিকিশোর স্বপ্নে দেখেছিলেন। 
 
মায়ের এই বিশেষ রূপের পুজোর আচারও ভিন্ন। এখানে বৃহৎনান্দীকেশ্বর পুরাণ মতে পুজো হয়ে থাকে। ললিতাসপ্তমী তিথিতে কাঠামোপুজো করা হয়। প্রথানুযায়ী ঠাকুরদালানেই প্রতিমা গড়া হয়। সপ্তমীর সকালে চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর মায়ের প্রতীকি রূপকে দর্পণে মহাস্নান করানো হয়। স্নানে ১০৮রকমের জল লাগে, তিন সমুদ্রের জল, গঙ্গার জল, দুধ, শিশির, মধু ইত্যাদি। ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং চালকুমড়ো বলি দিয়ে হয় সন্ধিপুজো হয়। পুজোর তিনদিনই একটি করে আখ, চালকুমড়ো বলি হয়, নবমীর দিন শত্রু বলি হয়। চাল গুঁড়ো অর্থাৎ পিটুলি দিয়ে মানুষের আকৃতি গড়ে কচু পাতায় মুড়ে বলি হয়। এবাড়িতে অন্নভোগ দেওয়ার রীতি নেই এখানে, সাড়ে বারো কেজি কাঁচা চালের নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। দশমীর ভোগে থাকে ভাত, কচুর লতি, শালুক শাপলা শাক, আমড়া ইত্যাদি। দশমীর সকালে দর্পণ বিসর্জন হয়। 
 
বেলেঘাটার রামকৃষ্ণ নস্কর রোডে জমিদার হরিদেব ভট্টাচার্যের পারিবারে তিনশো বছর ধরে কৃষ্ণা মহামায়ার আরাধনা হয়ে আসছে।
পাবনার স্থলবসন্তপুরের হরিদেব ভট্টাচার্য ছিলেন নাটোরের রাণী ভবানীর জমিদারী সেরেস্তার কর্মচারী। যদিও তারা ছিলেন নদীয়ার আদি বাসিন্দা। হরিপদ ভট্টাচার্য ছিলেন মা কালীর উপাসক। তিনি কৃষ্ণবর্ণা কালীর উপাসনা করতেন তন্ত্রমতে। একদিন তিনি স্বপ্নাদেশ পেলেন, দেবী কালী তাঁকে দুর্গাপুজোর নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু দুর্গা মুর্তি হবে কৃষ্ণাবর্ণা। সেই শুরু হল পুজো। সময়টা ১৭৩২- ৩৩ নাগাদ। 
 
কিন্তু কৃষ্ণা দুর্গার পুজো পদ্ধতি কেমন হবে? পুরোহিত ও শাস্ত্রজ্ঞরা কোনও বিধান দিতে পারলেন না। হরিপদ ভট্টাচার্য পাড়ি দিলেন কাশীধামে। সেখানেই এক সাধকের কাছে শ্রী শ্রী চন্ডীতে বর্ণিত মহামায়া কৃষ্ণার উপাসনার কথা জানলেন। পাবনায় ফিরেই হরিপদ ভট্টাচার্য তালপাতার পুঁথিতে কৃষ্ণাবর্ণা দেবী মহামায়ার আবাহনের পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করা শুরু করলেন। দেশভাগের পর তারা চলে আসেন এপার বাংলায়। তারপর থেকে বেলেঘাটায় মহামায়ার আবাহন চলছে। কালীঘাটের পটুয়াপাড়ায় দেবী প্রতিমা তৈরি হয়, পঞ্চমীর দিন মা মহামায়াকে নিয়ে আসা হয়। 
 
একচালায় দেবী কৃষ্ণা মহামায়ার গাত্র কৃষ্ণ বর্ণের হলেও মায়ের সন্তান-সন্ততিদের বর্ণ স্বাভাবিক। দেবীর দক্ষিণদিকে অবস্থান করেন লক্ষীদেবী ও কার্তিক। বামদিকে দেবী সরস্বতী ও গণেশ। মহামায়া এখানে ভদ্রকালী রূপে তন্ত্র মতে পূজিতা হন। কালিকা পুরাণ মতে চারদিনের পুজো অনুষ্ঠিত হয়।  মায়ের বিসর্জন হয় দশমীতে। মহিষ বলির বদলে চালকুমড়ো, আখ, কলা, আদা ও শসা বলি দেওয়া হয়। দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। প্রায় তিন শতক যাবৎ এই পুজো চলছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...