বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে...

বাংলা মাসের খেয়াল আমাদের থাকে না। কিন্তু বছর শেষের মাসটা যে দোরগোড়ায় সে কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই ডাক।

 কোরা শাড়ি, মলিন ধুতি, লাল সুতোর গামছা, খালি পা। চৈত্র  ডাক দিলেই গাজন সন্ন্যাসীরা বেরিয়ে পড়েন পথে। সকাল- সকাল মাধুকরির ডাক। আগুনে রাস্তা, তেতে ওঠা মাটি পার হয়ে মুঠো খানেক আলো চাল আর খুচরো পয়সায় মাসব্যাপি কৃচ্ছযাপন। গ্রীষ্মের রূপ রুদ্র সন্ন্যাসীর। মাধুকরী আর স্বপাক আহারের কৃচ্ছে সাধন যেন তার সঙ্গে সমঝোতা করে নেওয়ার চেষ্টা।  

রোদ জ্বলা দুপুরে বেজে ওঠে গাজনের ঢাক।  

বাংলা বছরের শেষ উৎসব গাজন। তার সঙ্গেই গায়ে-গা লাগিয়ে থাকে চড়ক।

এই উৎসবের উৎস সন্ধানে বই-পত্তরের পাতা ওলটালে একাধিক তথ্য মেলে। অভিধানের মতে রাঢ় বঙ্গের শৈব সংস্কৃতির একটা বিশেষ অঙ্গ গাজন’ গাজন অর্থে গাঁ-গ্রাম, জন-মানুষ। অর্থাৎ গ্রামীণ মানুষের নিজস্ব উৎসব।

কোনও মতে অবশ্য গাজন শব্দটির জন্ম ‘গর্জন’ থেকে। সন্ন্যাসীদের হুঙ্কার রব শিবসাধনায় গাজন। ব্রহ্মবৈবরত পুরানের প্রকৃতি খণ্ডে একটি শ্লোক আছে। তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “ চৈত্র কিংবা মাঘে এক-সাত-দশ কিংবা তিরিশ দিন হাতে লাঠি নিয়ে শিবব্রতী হয়ে নৃত্য ইত্যাদি করলে মৃত্যুকালে শিবলোক প্রাপ্তি হয়। তার নিরিখেই চড়ক বা গাজন উৎসব।

বাংলার মঙ্গলকাব্যেও গাজন উৎসবের কথা রয়েছে।

আলাদা করে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল,  লিঙ্গপুরান বা অন্যান্য শিব কেন্দ্রিক পুরাণগুলোতে চৈত্রমাসে শিবের আরাধনার কথা বলা হলেও চড়কের কথা নেই। বাস্তব হল সেই সময় সমাজের উচ্চস্তরে চড়ক উৎসব কে খুব একটা এলিট চোখে দেখা হত না। এই উৎসব আদ্যন্ত অন্তজের উৎসব।

পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ছিল। একটা সময় চড়ক চিহ্নিত ছিল বৌদ্ধ উৎসব হিসাবে। ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের উত্থান পর্বে পরাজিত বিতাড়িত বৌদ্ধরা আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়। সে সময় তারা নির্জন বন, শ্মশান,  প্রান্তিক অঞ্চল খুঁজে নিত প্রাণ বাঁচানোর জন্য। ধর্ম সাধনার নিজস্ব ধারা রক্ষা করতে তারা ছদ্ম পথ গ্রহণ করে। ব্রাহ্মণ্য আগ্রাসনের চোখে ধুলো দিতে নানা প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের মধ্যে স্ব-দেবতার রূপ কল্পনা করে। তার ফলশ্রুতি চড়ক।

চড়ক পুজো মূলত ধর্ম ঠাকুরের পুজো। পরবর্তী সময়ে যা শিবের গাজন হয়। ধর্ম ঠাকুর আদতে বৌদ্ধ দেবতা ধর্মরাজ। গ্রামের নিম্ন বর্গীয় মানুষ ধর্ম ঠাকুরের পুজো করে। ধর্ম ঠাকুরের বিশেষ কোন মূর্তি দেখা যায় না। বেশির ভাগ জায়গায় পাথর খণ্ড পুজো করা হয়।

কোনও কোনও গ্রামে গাজনে ধর্ম ঠাকুর আর শিব দুই দেবতারই পুজো হয়। শিবের গাজন হয় চৈত্রমাসের শেষ সপ্তাহে,  শেষ হয় চড়কের দিন। ধর্ম ঠাকুরের গাজন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়ে।   

গাজন উৎসবের তিনটে ভাগ। ঘাট সন্ন্যাস। নীলব্রত। চড়ক।

আগে চৈত্র মাসের শুরুর দিন থেকে ভক্তরা সন্ন্যাস নিতেন। তবে এখন সেই প্রথা কিছুটা আলাগা হয়েছে। সন্ন্যাস করা হয় বলে গেরুয়া বা সাদা বস্ত্র ধারণ, হবিষ্যি গ্রহণ ও কৃচ্ছসাধন আবশ্যক। একটি দলের মধ্যে একজন মূল সন্ন্যাসী আর একজন শেষ সন্ন্যাসী থাকেন। দুজনেরই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

গাজনের পরের দিনটা নীল ষষ্ঠীর পুজো। মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনায় নীলাবতী আর নীলকণ্ঠ শিবের পুজো করেন। এইদিন গাজন সন্ন্যাসীদের নানা রকম দান করে থাকেন তাঁরা।

চৈত্রের শেষ দিন চড়ক উৎসব।

চড়ক পুজোর আগের দিন চড়ক গাছকে স্নান করিয়ে শুদ্ধ করা হয়। একটি পাত্রে জল ভরে শিবের প্রতীক হিসাবে শিবলিঙ্গ রাখা হয়। যার নাম বুড়োশিব। সংক্রান্তির দিন চড়ক গাছে গামছা, দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘোরানো হয় সন্ন্যাসীদের

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী গাজন উৎসবের দিন শিব-গৌরির বিয়ে হয়। বিয়েতে গাজন সন্ন্যাসী শিবের চেলারা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেয়।

অঞ্চল ভেদে আলাদা আলাদা লৌকিক দেবতার সঙ্গে গাজনের যোগ রয়েছে। শিবের গাজন, ধর্মের গাজনের পাশাপাশি মনসার গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন।

তবে এই উৎসবকে অন্য চোখে দেখলে সম্পূর্ণ আলাদা একটা অর্থ পাওয়া যায়। এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য, আর জায়া রূপে কল্পিত পৃথিবী।

চৈত্র মাসের শুরু থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য ভীষণ হয়ে ওঠে। তখন সেই তেজ প্রশমন ও বৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী মানুষ এই উৎসব সৃষ্টি করে। গ্রামের শিব মন্দির কে কেন্দ্র করে যার উৎপত্তি।

আবদ্ধ দেবতা এই উৎসবে চার দেওয়ালের জাঁক মুক্ত হয়ে মেঠো মানুষের অন্দরে জায়গা করে নেন। এখানে কুল- জাত-মানের দম্ভ নেই। শ্মশানে- মশানে ঘুরে বেড়ানো দেবতা তখন মাটির কাছাকছি।

 বদলে যাওয়া সমাজের চালচিত্রেও বহমান সেই ধারা। সময় বদলেছে। মানুষ বদলেছে কিন্তু বদলায়নি আবেগের প্রবাহ।

 মেইন স্ট্রীম ব্র্যাকেটের বাইরে থাকা পিছড়ে বর্গের মানুষের উজাড় করা ভালোবাসায় মুক্ত দেউল বন্দী ঈশ্বর। চৈতি হাওয়ার দামাল টানে ভেসে যান। দোমড়ানো- মোচড়ানো জীবনের ক্লেশ আর যাপনের গ্লানিকে ছাপিয়ে মুখর হয়ে ওঠে দেবতাকে জয় করার আনন্দ।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...