ভাষার এক অনন্য ভাস্কর বিষ্ণু দে’র জন্মদিনে

তবুও রাত্রিতে শোনা যায়।

নাকি ঐ ক্ষীণ সুর বহুদূর নক্ষত্রসঙ্গীত মাত্র ?

স্বপ্নের বেহালা বুঝি বেজে চলে মহাশূন্যতায়

শুনি যে তা মনে হয় শুধু বুনি স্বপ্নময়

নীলে, মহাশূন্যতায়, ছাদে ছাদে খোলা জানালায়।

 

কারণ উদগ্র দিনে গ্লানির জ্বালায়

সে-গীতবিতান অশ্রুত সঙ্গীত প্রায়,

কোমলগান্ধারে যা শোনা উচিৎ ছিল

কানাড়ার পাকে-পাকে, কিংবা এ-মাইনরের

হাইলিগে দাঙ্গেসাঙ্গে, অহোরাত্র

বিংশ শতাব্দীর প্রজ্ঞাপারমিতার বিজ্ঞানে

প্রতিশ্রুত সমবেত পরিপূর্ণতায়।

নক্ষত্রধ্বনিত কম্প্র অন্ধকারে ডুবে যায় গৃধনুরও কারবার।

 

[- দিনকে রাত্রির নীলে, আমার হৃদয়ে বাঁচো (প্রথমাংশ), বিষ্ণু দে, জুন ১৯৮১]

 

তিরিশের আধুনিক বাংলা কবিতার নিরিখে নব্য ধারা নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের ঠিক পরেই যার নাম অনিবার্য ভাবে উঠে আসবে, তিনি বিষ্ণু দে। ১৯০৯ সালে আজকের দিনে (১৮ই জুলাই) ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার এই অন্যতম কবি-প্রাবন্ধিক।

FotoJet (62)

কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে বঙ্গবাসী কলেজে ‘আই এ’ পড়তে যান এবং ইংরাজি বিষয়ে স্নাতকস্তরে উত্তীর্ণ হন সেন্ট পল্‌স কলেজ থেকে ১৯৩২ সালে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজিতে এম-এ পড়ে ১৯৩৫ সালে শিয়ালদহের রিপন কলেজে ( সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন

১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত মৌলানা আজাদ কলেজে অধ্যয়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। কিছুদিন পর কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার গুরুভার গ্রহণ করেছিলেন।

১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকার সূচনার মাধ্যমে যে সাহিত্যের সূচনা আমরা দেখি, বিষ্ণু দে তারই একজন পথিকৃৎ। তিনি বামপন্থী ভাব ও দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন খুব অল্প বয়সেই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাঁর কবিতার মূল বিষয় মানুষের সংগ্রাম -তার রাজনীতি, ইতিহাস। একাধিক প্রেমের কবিতাতেও দেখতে পাওয়া যায় মানুষের সংগ্রামেরই এক আবেগঘন প্রতিমূর্তি। তিনি যেমন বাংলা তথা দেশের জাতীয় ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনই তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন ইউরোপের ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের ধারায়। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র, দাঙ্গা, তেভাগা আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর কবিতায় অবিরত রেখাপাত করেছে।

FotoJet (49)

লেখালেখি, পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও অনুবাদ সাহিত্যের দিকেও তাঁর নজর ছিল প্রবল। টি.এস.এলিয়টের ভাবনা ও রচনাশৈলী তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি আরাগ'র কবিতার দিকেও ঝুঁকেছিলেন। তার লেখায় যেভাবে আমরা মার্ক্সের প্রভাব দেখতে পাবো, একইসাথে দেখতে পাবো ফ্রয়েডিয় প্রভাব। পরে তিনি অনুবাদ করেন এলিয়েট, মাও সে তুং ও পল এল্যুয়ারের লেখাপত্র। ১৯৫৮ সালে অন্যান্য কাব্যগুলোর পাশাপাশি প্রকাশিত হয় তাঁর বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ।

বিষ্ণু দে-র ভিতর নতুন একটি পথের হদিশ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কবিতায় যেমন আছে প্রচ্ছন্ন শব্দের বৈচিত্র্যময় খেলা-বহিঃপ্রকাশ, তেমনি রয়েছে শব্দের ক্রেংকার। তাঁর ছন্দ সচেতন, কৃত্রিম নয়; অনুভূতির সঙ্গে লালিত ছন্দের এক অপূর্ব মেলবন্ধন সম্পর্কে তিনি সদা জাগ্রত। যদিও তাঁর কবিতা কখনও দেখা দেয়নি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হয়ে। দুর্বোধ্যতা কখনও উঁকি দিয়েছে কেবল। শব্দ ও ছন্দের অসাধারণত্ব বিষ্ণু দে-র কাব্যসুষমার পারদে পারদে অনাদি বিস্তৃতির মাধ্যমে এনেছে কাব্যসুরাহা। এ ভাষা তিনি লালন করেছেন মহানগরে বসে একা নিভৃতে, সে ভাষাই তাঁর একান্ত খুব কাছের হয়ে তার নিজস্ব নাগরিক ভাষায় রূপ পেয়ে প্রকাশিত হয়েছে লেখ্যরূপে, কবিতা হয়ে। বিষ্ণু দে-র সমসাময়িক জীবনানন্দ দাশ যেমন বেছে নিয়েছিলেন নিঃসঙ্গতা ও প্রকৃতিকে। এসবের মাঝেই তিনি বারবার অলৌকিক ভাষার সেতু অতিক্রম করে চলে গিয়েছিলেন ভাবের ঐতিহাসিক এক পরপারে।

বিষ্ণু দে তাঁর কবিতা, লেখায় গীতিধর্মের বোধের সাথে নিয়ে এসেছিলেন লিরিকাল এক অনুভূতি। শুরুতেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন নাগরিক এই শব্দমালাগুলিকে। এর বিস্তার আমরা তাঁর সাহিত্যজীবনের শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য করতে পারি।

FotoJet (47)

 

১৯৩২ ঘেকে ১৯৮১-এর মধ্যে তাঁর রচিত বইগুলিঃ

 

ছড়ানো এই জীবন (আত্মজীবনী), উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২), চোরাবালি (১৯৩৮), পূর্বলেখ (১৯৪০), রুচি ও প্রগতি (১৯৪৬), সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২), সন্দীপের চর (১৯৪৭), অন্বীষ্টা (১৯৫০), নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫০), তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮), রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্য আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬), মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭), ইন দ্য সান অ্যান্ড দ্য রেন (১৯৭২), উত্তরে থাকে মৌন (১৯৭৭), সেকাল থেকে একাল (১৯৮০),স্মৃতি সত্ত্বা ভবিষ্যৎ ( ১৯৭১), আমার হৃদয়ে বাঁচো (১৯৮১)।

FotoJet (63)

শুধুমাত্র সাহিত্য জগৎ নয়.. নৃত্য, নাট্য, চিত্র, সংগীত ও শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমগুলির প্রতি একইরকম দ্বিধাহীন ও শ্রদ্ধাশীল, চেয়েছিলেন শিল্পের এই দিকগুলোর দ্বারা আরও বিকশিত হতে। যামিনী রায় থেকে গোপাল ঘোষ, পল সেজান থেকে পাবলো পিকাসো, মনে থেকে মাতিস, আইজেনস্টাইন, সত্মানিসস্নাভস্কি — প্রত্যেকের সম্পর্কেই তিনি ছিলেন সর্বদা সচেতন এক ব্যক্তিত্ব। আধুনিক মনোবিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বে, তাঁর দখল ছিল বিস্ময়কর রকমের। জীবনের অভিজ্ঞতা ও সাহিত্য পাঠলব্ধ অনুভূতিকে কেন্দ্র করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর নিজস্ব একক এক ভাষার ভাস্কর্য

 

তাই রাত্রিকে হৃদয়ে বাঁধি

চৈতন্যের মহাবিশ্ব নীলে,

নাক্ষত্রিক নীলে,

যদি মর্ত্য মৃত্তিকায় কর্দমাক্ত রাজপথে দৈনিক বিপথে

দুর্দশায় ব্যপ্ত হয় আমাদেরই তরঙ্গিত ছন্দে মিলে

সুরে-সুরে মানবিক জীবনের প্রাকৃত প্রতিষ্ঠ এক পরম সঙ্গীত,

কলকাতারও স্তব্ধতায় শুদ্ধ উজ্জীবিত

যে-সংগীতে উদ্দেশ্যের পূর্ণতায়

সমাহিত হয়ে যায় সর্ববিধ আধি,

ফাঁকে ফাঁকে নিমগাছের শিহরনে যে-সংগীত

রাত্রির চৈতন্যে দেখা যায়।

দিনকে রাত্রির নীলে অবিচ্ছিন্ন রাখি বারবার

দীর্ঘায়ু নিষ্ঠায় ৷৷

 

[- দিনকে রাত্রির নীলে, আমার হৃদয়ে বাঁচো (শেষাংশ), বিষ্ণু দে, জুন ১৯৮১]

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...