শীতকাল বাঙালির দূর্বলতা। প্রেম আর অপ্রেম দু’দিন থেকেই। একে তো ঠাণ্ডার চোটে সক্কাল সক্কাল লেপ কম্বলের তলা থেকে বেরতে তার বেজায় আপত্তি তার ওপর এই ঋতু এমন সেজেগুজে মোহিনী রূপে ধরায় ধরা দেয় যে তার কাছে ধরা দেবেই হৃদয়। সে খাবার প্লেট হোক বা বেড়ানোর ব্যাগপত্তরে। আর সে মনে মনে কেবল বলে চলে ‘শীতকাল তুমি কার?’
ভূতের রাজার তিন বরের প্রথম দুই বর তারা পূরণ করে নেয় এই শীত কালেই। শুধু বেশ বদলের বরটার খেদ থেকে যায় খানিকটা। কারণ হাজার ইচ্ছে করলেও জ্যাকেট, টুপি, পুলওভার থেকে বেরনো যায় না। তাতে অবশ্য খুব অসুবিধা নেই জাতির। হাওয়ায় শীতের আমেজ লাগলেই শুরু হয়ে যায় তার দিনগোনা। সারাবছর যে মিষ্টির দোকানের পানে চায় না সেও তাকিয়ে থাকে শোকেসের ওপারে রাখা ট্রে’র দিকে, প্রশ্ন একটাই-সে কি এলো, নাকি এল না?
সে’টা কে?
কে আবার, নলেন গুড়ের রসগোল্লা। শীতকাল বাঙালির কাছে নলেন গুড়ের নাকি মোয়ার- এই নিয়ে যদি চ্যানেলের চ্যাট শোতে ভাবেন ভাল আসর জমানো যাবে, দেখবেন সে চান্স একেবারেই নেই। কারণ এই গুড়ের রসগোল্লা আর জয়নগরের মোয়ার নাম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার মধ্যে শীতঘুম ভেঙে জেগে উঠবে আরও হরেক নাম- পাটিসাপটা, পুলি পিঠে, গুড়ের পায়েস, হালুয়া কত নাম। ওকি কেক আর প্যাটিস বাদ পড়ল যে।
ডিসেম্বর শুরু হল কী হল না হুড়মুড়িয়ে খোঁজ পড়ে বেকারির। নাহুমস, ফ্লুরিজ, সালভাদোর কত কত নাম। বাদ দেওয়া যায়? তাহলে যে বাঙালির বৃথা ডিসেম্বর। সেটি হচ্ছে না।
এসব শুনে কেউ যদি ভাবে শীতকাতুরে বাঙালি মণ্ডা মিঠাই ছাড়া আর কিছু চায় না তাহলে সে গোল্লা পেল পরীক্ষায়! কেন ওই যে সকাল বেলা বাক্স থেকে উঁকি মারছে শিঙাড়ার শিং, ফুলকপির গন্ধ, সে বুঝি কিছু নয়!
শীতকালে তেলেভাজার দোকানে ফুলকপির শিঙাড়ার খোঁজ পড়বে না তা কি হয়? প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার হওয়ার আগেই তাই রসুইঘর থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় হাতে লেখা পিচবোর্ড। সাদা পাতায় মোটা দাগে লেখা ‘ফুলকপির শিঙাড়া’র হদিশ।
তারমধ্যেই এসে পড়ে আর এক শীতের অতিথি। কড়াইশুঁটির কচুরি। পাড়ার মোড় বা অন্য কোথাও নয়, সরাসরি এক্কেবারে বাড়ির হেঁশেলে। বাজারে মটরশুঁটির উঁকি একটু ‘রেগুলার’ হলেই ফি রাতে হেঁশেলে উৎসব। রেডি টু কুক-এর অপশন চলবে না ভাই, চাই আসল স্বাদ। গত দু’হাজার বছরেও এ স্বাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি কেউ। ফুলকো কচুরির গায়ে হালকা সবুজ রং, সঙ্গে লাল টুকটুকে নতুন আলুর দম। ধনেপাতার হালকা ফ্লেভার! কটা খাচ্ছি গুনতি থাকে!
নভেম্বরের শেষ মানেই হেঁশেলে জমিয়ে ব্যাট করতে শুরু করেছে ফুলকপি। চিকেন, মাটনের রোস্টকে ড্রেসিং রুমে বসিয়ে রেখে এই সময়টা ছক্কা হাঁকায় ফুলকপির রোস্ট! কই ফুলকপি, দিশি ভেটকি আর ফুলকপির ঝোল, ফুলকপির পায়েস লম্বা লিস্ট আছে শীতের জোব্বার পকেটে।
ওমা সবকিছু নিরামিষ খাব নাকি! এমন বীর আর কে হতে চায়! কে যেন বলেছিল শীতে নাকি হাঁসের ডিমের সাইজ বেড়ে যায়? সেটা ঠিক বোঝা না গেলেও হাঁসের ডিমের কষা বেজায় সোয়াদ লাগে এসময়। মশলামাথা সাদা অংশটা সরালেই ডিমের ভিতর একেবারে টাইগার হিলের সূর্্যোদয়। টকটক করছে কুসুম। তবে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আনা ডিমে এ দৃশ্য পাবেন না। যেতে হবে বাজারের একেবারে শেষ প্রান্তে। কলমি, বেতো, গেঁড়ি, গুগলি নিয়ে চুপ করে বসে থাকা মাসিদের কাছে। ওসবের সাথে থাকা মাটি লাগা ডিম। ডিম নয়, ভোজন রসিকদের কাছে এ হল চাঁদের পাহাড়ের হীরেমানিক!
শুকিয়ে আসা পুকুরের কমা জলে খেলে বেড়ায় মাছগুলো। ভোরে জাল ফেললেই খলবলানি। একটু সক্কাল সক্কাল বাজার জেতে পারলে ব্যাগের ভিতর লাফ কাটে। রগরগে করে তেলঝাল। তইখন বারিতে রান্না হত তোলা উনুনে। শেষ আঁচে বসিয়ে বসিয়ে রান্না হত চুনো চচ্চড়ি। শোল-বোল-পুঁটি-চারার ঝাল। বাটা লঙ্কা আর তেলে জব্দ। উনুনের আঁচটুকু বাদ দিয়ে বিশেষ বদলায়নি বাজারে এই ‘দিশি’র অ্যাপিল। সঙ্গে থাকে আর এক সুন্দরী। নাম তার পেঁয়াজকলি পোস্ত। দয়া করে দীনের কুটিরে তার দু’দিনের যাতায়াত। মাথার ওপর লেগে থাকা কুঁড়ি ফুটে গেলেই সে গৃহিণীর প্রাক্তন।
পিকনিক, ফিস্ট, পার্টি, ছাদভোজন, পিঠের নেমন্তন্ন, কেকের নেমন্তন্ন, বছর শুরু, বছর শেষ, জন্মদিন, বিয়ে- শীতকাল জুড়ে শুধু ভুরিভোজের আমন্ত্রণ। ক’দিনের শীতকালের জন্য সারাবছর হাপিত্যেশ করে বসে থাকা। শীতকাল এলে ভেতো বাঙালির ঘরে চিমনি জ্বলে না, স্নো ফ্লেক্স, স্নো ফল কোনটাই নেই। কিন্তু তাতে তার বিশেষ কিছু যায় আসে না।
শীতকালকে বাঙালি যেভাবে বুঝেছে পৃথিবীর আর কোথাও বোধহয় সে নজির নেই। দিশি-বিদেশি সব মিলিয়ে মিশিয়ে একেবারে নিজের মতো বাবুয়ানি। শুরুটা যদি ক্রিসমাসে হয় শেষটা তাহলে সরস্বতী পুজোর ভোজে। ফুলকপির খিচুড়ি, কুলের অম্বল থেকে শুরু করে গোটা সেদ্ধ ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবটা চাই!