বাঙালির বছর শুরু হয় বৈশাখে। চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ আসে। নতুন বছর আরম্ভ হয়। ক্যালেন্ডার, পঞ্জিকা, নতুন জামা, মিষ্টিমুখ সব মিলিয়ে জম্পেশ ব্যাপার। সঙ্গে থাকে লক্ষ্মী গণেশের আরাধনা। কিন্তু চিরকাল থেকেই কি বৈশাখে শুরু হত বছর? কী বলছে ইতিহাস?
আসুন জেনে নিই, তার আগে বরং বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব নিয়ে কিছু কথা-বার্তা বলি। দুগ্গা পুজো। বাঙালির বছরব্যাপী প্রতীক্ষা শেষ হয় ষষ্ঠীর দিন আর প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শুরু হয় দশমী থেকে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে দশমীকে দশেরা হিসেবে পালন করা হয়। পৌরাণিক ইতিহাস বলে, নয় দিনের যুদ্ধ শেষে শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে, দেবী বিজয়ী হয়েছিলেন; তাই তিথিটি বিজয়া দশমী। রামায়ণ বলে, রাম-রাবণের যুদ্ধও শেষ হয়েছিল এই দিনে। কিন্তু বঙ্গে বিজয়া দশমী ঠিক কেমন? তা কি বিষাদের উৎসব?
দুর্গার বিদায় দুঃখের। অপরাজিতা পুজো সেরে, নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে মাকে বিদায় জানানো হত এককালে। মহাসমারোহে বিসর্জনের শোভাযাত্রা চলত। আজও চলে। বনেদি বাড়ি ভেদে নানান ধরণের আচার-অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। কোথাও কোথাও তোপ দেগে, বন্দুক চালিয়েও মাকে বিদায় জানানো হত। অনেক বাড়িতেই মাকে শেষ দিনে ভোগে পান্তা ভাত আর কচুর শাক দেওয়া হয়, কারণ মর্ত্যবাসীর বাবাজীবন শিব যাতে মায়ের ভাল-মন্দ খাওয়ার বিষয়ে টের না পান। বিসর্জনের পর চলে বিজয়ার পালা, অর্থাৎ মিষ্টি মুখ, কোলাকুলি, প্রণাম, স্নেহ-আশীর্বাদ বিনিমিয়। বিজয়ায় গজা, নিমকি, নাড়ুদের ব্যাকফুটে ঠেলে সন্দেশ, রসগোল্লা দিব্য জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সেকালের কলকাতায় বিসর্জনের মিষ্টি মুখের ব্যাঞ্জন ছিল নারকেল ছাপা। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত তেমনই লিখে গিয়েছেন। এছাড়াও অনেক রীতি রয়েছে, যেমন দশমীর দিন কোনও কোনও বাড়িতে জোড়া ইলিশ আনা হয়, যাত্রা ঘট পাতা হয় আবার লক্ষ্মী পুজোর কদম ফুল কিনে ফেলা হয়। নিয়ম রীতির অন্ত নেই বাঙালির। কিন্তু উমার বিদায় তো সত্যিই দুঃখের তবে কোলাকুলি আর মিষ্টি মুখের অবতারণা কেন? দুঃখ ভুলতে এমনটা করা, নাকি অন্য কারণ রয়েছে?
উত্তর খুঁজতে টাইম মেশিনে চাপতে হয়। ফিরে যেতে হয় বেদের কালে। ঋগবেদের সময় এক শরৎ থেকে আরেক শরতে বছর গণনা করা হত। শরৎ ঋতুতেই বছর আরম্ভ হত। তখন দীর্ঘায়ু কামনায় বলা হত, 'জীবেম শরদ শতম'। ওটিই হাল আমলের শতায়ু কামনায় পরিণত হয়েছে। বিজয়া দশমী ছিল শরৎ বর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ বিজয়া দশমীই হল নববর্ষের উৎসবের দিন। এইদিন আত্মীয়-পরিজন নিয়ে আনন্দ-আল্লাদে, খাওয়া দাওয়ার মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করার নিয়ম ছিল। মনে করা হত, বছরের প্রথমদিন ভাল কাটালে সারা বছর ভাল যাবে। বিজয়া নামের উৎপত্তির একটি সঙ্গত কারণ এখানে খুঁজে পাওয়া যায়, এইদিনটিতে প্রার্থনা করা হত 'নববর্ষে সকলের বিজয় হউক'।
এই সম্পর্কিত একটি রীতির কথা স্বামী বিবেকানন্দের ভাই শ্রী মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখে গিয়েছেন, "তখনকার দিনে নবমীতে পাঁঠা ও মোষ বলি করিয়া গায়ে রক্ত, কাদা মাখিয়া মোষের মুন্ডু মাথায় লইয়া পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা হইত। আর, বৃদ্ধ পিতামহ তাহার সমবয়স্ক লোক, পুত্র, পৌত্র লইয়া, হাতে খাতা লইয়া ‘কাদামাটির গান' করিত। সেসব অতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য গান। বাটির মেয়েদের সম্মুখেও সেইসব গাওয়া হইত এবং পাছে ভুল হয় এজন্য হাতে লেখা খাতা রাখিয়া দিয়াছে। ইহাকে অপর কথায় ‘খেউড় গান' বলিত। তখনকার দিনে এসবের প্রচলন ছিল এবং লোকে বিশেষ আপত্তি করিত না, বরং আনন্দ অনুভব করিত। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা ও কেশব সেন মহাশয়ের অভ্যুদয় হইতে ধীরে-ধীরে এসব উঠিয়া যায়।" নবমীতে এমনটা করা হত, কারণ বিশ্বাস ছিল কাদামাটি মেখে থাকলে যম স্পর্শ করতে পারবে না। বছরের শুরু দিনে এমন থাকলে, গোটা বছর ভাল কাটবে। কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে পুণ্য লাভের সে ধারণা তো আবহমান কাল ধরে চলে আসছে।
সুস্পষ্টভাবে বললে, বৈশাখের নববর্ষ বা পুন্যাহ হল ব্যবসায়ীদের, যদিও এককালে জমিদার, ভূস্বামীদের খাজনা আদায়ের জন্যেই তার প্রচলন ঘটেছিল। অগ্রহায়ণে নবান্ন হল কৃষকদের নববর্ষ। আম বাঙালির নববর্ষ ছিল বিজয়া দশমী। যা দুঃখের নয়, বরং আনন্দের উৎসব। কালে কালে সেই নববর্ষ হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রয়ে গিয়েছে সামাজিক আচারগুলি। প্রণাম, আশীর্বাদ, মিষ্টি মুখ আজও সেই স্মৃতি বহন করছে। ইতিহাস বলে, শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকেই বঙ্গাব্দের শুরু। ফলে তখন থেকে বাঙালি নববর্ষের প্রচলন। এদিন কৃষকরা, রাজা, মহারাজা, জমিদারদের পাওনা মিটিয়ে দিতেন। রাজস্ব পূরণের পর তাদের মিষ্টি মুখ করানো হত। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আজও যা হালখাতা হিসেবে রয়ে গিয়েছে। পাওনা মেটানো, মিষ্টিমুখ সব চলে আসছে। বইপাড়ার আড্ডা, বসুশ্রীর আড্ডা আজ অতীত। তবুও ময়দানে বার পুজো, কালীঘাট-দক্ষিণেশ্বরে হালখাতা পুজো দিতে ব্যবসায়ীদের উপচে পড়া ভিড় আজও বৈশাখের আগমনী বার্তা দেয়।