বাংলার লোকঐতিহ্যে জিতাষ্টমীর উৎসকথা

আশ্বিনের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে জিতাষ্টমী এপার-ওপার দুই বাংলারই বেশ পরিচিত একটি ব্রত। ব্রতের সূচনা-সংক্রান্ত অতিপরিচিত একটি ব্রতকথাও রয়েছে; সেটি প্রথমে বলে নিই, তারপর অন্য কথায় আসছি। শুনুন:



শালিবাহন নামে এক রাজা ছিলেন। দানধ্যান, ধর্মকর্ম, দেবদ্বিজে ভক্তি প্রভৃতি মোক্ষপথের সবই তিনি পরম যত্নে পালন করছিলেন, তবু তাঁর মনে কোন সুখ ছিল না। সুখ ছিল না, কেননা, তাঁর কোন সন্তান ছিল না।



সেই অ-সুখের মধ্যেই একরাত্রে রানির স্বপ্নে এলেন এক হাঁসেচড়া ঠাকুর। সেই ঠাকুর রানিকে বললেন, অশ্বিনের কৃষ্ণ অষ্টমী তিথিতে একবার জিতাষ্টমী ব্রত করো তো দেখি মা; তাহলেই তোমার সন্তান হবে। 



স্বপ্নের মধ্যেই রানি ঠাকুরকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলেন, সে-ব্রতের তো কিছুই জানি না, বাবা। দয়া করে তুমিই বলে দাও কেমন করে সে-ব্রত পালন করব!



তখন সেই হাঁসেচড়া ঠাকুর ব্রতের সমস্তই রানিকে শিখিয়ে-বুঝিয়ে দিয়ে তবে অদৃশ্য হলেন। তারপরই রানির ঘুমটি ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই রাজাকে তুলে সেই স্বপ্নের কথা জানালেন। সব শুনে রাজা দারুণ খুশি হয়ে ব্রতের আয়োজন শুরু করলেন।

jita-2

আশ্বিনের কৃষ্ণ অষ্টমী তিথি। রাজারানি দুজনেই উপোষ করে উঠোনে ছোট্ট একটি পুকুর কেটে তার ঠিক মধ্যিখানে কলা ও বেলগাছ পুঁতে ফলের নৈবেদ্য নিবেদন করে ব্রত করলেন। ব্রতের ঠাকুর তাঁদের পুজো ও প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে কোলে একটি পুত্র এবং একটি কন্যা দিলেন। রাজরানির তখন সুখের আর সীমা রইল না। তাঁরা পুত্রের নাম রাখলেন জীমূতবাহন, কন্যার নাম দিলেন সুশীলা।



পুত্রকন্যা পেয়ে তাদের আপদবালাই যাতে দূরে থাকে, সে-জন্য রানি ফি-বছর জিতাষ্টমীর ব্রত করতে লাগলেন। এমনি করে দিন কাটতে লাগল। তারপর একদিন পুত্রকন্যারাও বড় হলেন। রাজরানি তখন উজ্যুগ করে তাঁদের বিয়ে দিলেন।



বধূমাতাও রাজার মেয়ে। তবে তাঁর শিক্ষা-সহবতের যথেষ্ট অভাব ছিল। নইলে রানি-শাশুড়ি উঠোনে পুকুর কেটে জিতাষ্টমী ব্রত করছেন, তাই দেখে কেউ হাসাহাসি করে, উপহাস করে!



তাতেই বোধহয় ব্রতের ঠাকুর রুষ্ট হলেন। তাই বুঝি বছর বছর বধূমাতা সন্তানবতী হলেও গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে-না-হতেই মারা যেতে লাগল। সংসারে আবার অ-সুখ এসে ঘিরল। রানি বুঝলেন, এ নির্ঘাত দেবতার কোপ!



তিনি তখন বধূমাতাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ব্রত-পার্বণ পালন করতে শেখালেন, ঠাকুর-দেবতায় ভক্তি করতে শেখালেন। জিতাষ্টমীর ঠাকুরটির কাছে ক্ষমা চেয়ে আশ্বিনের কৃষ্ণ অষ্টমীতে ব্রত করতে বললেন। 



বধূমাতার তখন মতি ফিরেছে। তাই রানি যা-বললেন, যেমনভাবে বললেন তিনি তেমনি করে ব্রত সম্পন্ন করলেন। ব্রতের ঠাকুর তাতে ভারি তুষ্ট হলেন।



তখন বধূমাতার কোল ভরল, সংসার ভরল, সুখের ভাণ্ডার উপচে পড়ল। ঠাকুরের কৃপায় সে-সব খালি হওয়ার অলক্ষুণে দিন আর কক্ষনো এল না। তাই দেখে আর-সকল এয়োরা ব্রতের কথা বাড়ি বয়ে শুনতে এল, ব্রতের আচার শিখল, পরের বছর সে-ব্রত পালন করল এবং ব্রত-ঠাকুরের কৃপা পেল। এমনি করে ক্রমে ঘরে ঘরে জিতাষ্টমী ব্রতপালনের প্রসার ঘটল।



ব্রতকথা থেকে স্পষ্টই বোঝা গেল যে, ব্রতটি একান্তভাবেই সধবা ও এয়ো নারীদের ব্রত। অবশ্য কাহিনিতে রাজাকেও আমরা এই ব্রতে সামিল হতে দেখি। কাহিনি অনুযায়ী ব্রতের ফল দুটি, এতে নিঃসন্তানের সন্তানলাভ হয়, আর সন্তানবতীর সন্তান আপদ-বালাই থেকে দূরে থাকে। এদিক থেকে ব্রতের ঠাকুরটি যেন দেবী ষষ্ঠীরই পুরুষ রূপ। তাই বোধহয় রাঢ়ের অনেক স্থানেই এই ব্রত-পুজোকে 'বড় ষষ্ঠী'ও বলে।



নিয়ম ও আচার ভেদে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা প্রভৃতি জেলায় ব্যাপকভাবে এই ব্রতপালন করতে যেমন দেখা যায়; তেমনি দেখা যায় বিহার ও ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও।



এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই জিতাষ্টমীর 'জিতা' কথাটা এল কোত্থেকে? 'জ্যান্ত' রাখার দেবতা থেকে 'জিতা' কথাটা এলেও আসতে। আবার 'জিতা' কথাটি জীমূতবাহনের সংক্ষিপ্ত বা লৌকিক রূপও হতে পারে। এই জীমূতবাহনের সঙ্গে ওপরের ব্রতকথার কোন সম্পর্ক নেই। কেন নেই সেটাই এখন বলছি:



অনেকের মতে, জিতাষ্টমীর দেবতার নাম হল গিয়ে, 'জীমূতবাহন'। এবং, 'জীমূতবাহন' আসলে ইন্দ্রদেবতারই এক নাম। সুতরাং, এই ব্রতে ইন্দ্রেরই পুজো করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সন্তানকামনামূলক এই ব্রতে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রের পুজো কেন করা হয়? 



কেননা, ব্রতের সূচনাকালে মনে করা হয়েছিল যে, যে-ইন্দ্র বৃষ্টিপাতের মধ্য দিয়ে বন্ধ্যাভূমিকে শস্যশালিনী করেন, তিনি নিশ্চয়ই বন্ধ্যা নারীকেও সন্তান দান করতে সক্ষম হবেন। তাই সন্তানকামনায় তাঁর আরাধনা করা উচিত। এই ভাবেই হয়তো একদা শুরু হয়েছিল জিতাষ্টমীর ব্রতের ধারা।



বারিপাত যদি পুরুষের জন্মবীজ ও তার পতনের প্রতীক হয়, তাহলে তা ধারণ করার জন্য উঠোনে তৈরি হচ্ছে ছোট্ট পুকুর। যা প্রকারান্তরে নারীর জননেন্দ্রিয়ের প্রতীক। তাতে প্রাণ সঞ্চারের প্রতীকে রোপণ করা হচ্ছে কলা ও বেল গাছ (একটি ঝাড় বহুল উদ্ভিদ, অন্যটি বীজ বহুল ফল; দুটি স্থাপনের কারণটি বংশবৃদ্ধির কামনা), অঞ্চলভেদে বট গাছ, ধান গাছ, আখ গাছ (এগুলো রাখার কারণও আগের মতোই)। 



ব্রতের জন্য রাঢ় অঞ্চলে উপরের আয়োজনের সঙ্গে লাগে অঙ্কুরিত ছোলা এবং শসা। ব্রতের শেষে শসার ভেতর কিছু ছোলা ঢুকিয়ে ব্রতীনিকে ডুব দিয়ে জলের ভেতরে আড়াই কামড়ে সেই শসাটি খেয়ে নিতে হয়। এই আচারকে বলে, 'শসা ডুবা'। বোঝাই যাচ্ছে, এটি প্রাচীন সন্তানকামনার জাদু-যৌনাচার, এখনও ব্রতাচার হিসেবে পালিত হচ্ছে। ব্রতের জন্য মৃত্তিকা-নির্মিত শেয়াল-শকুন ও জীমূতবাহনের ছোট্ট ছোট্ট পুতুল-মূর্তি বিসর্জনের সময় যে ছড়াটি কাটা হয়, তার মধ্যেও সেই কামনা প্রতিফলিত:

'শেয়াল গেল খালকে,

শকুন গেল ডালকে,

শসা ডুবা আজকে।'

 

jita-1



ব্রতের জন্য নির্মিত ওই শেয়াল-শকুন জীমূতবাহনের অশুভ শক্তি। দুটোই মৃতভোজী। অমঙ্গলের প্রতীক।তাই ব্রত-পুজোয় তাদের তুষ্ট করে খালে-ডালে পাঠিয়ে অশুভ দৃষ্টির অগোচরে জলের আড়ালে দেবতার প্রসাদ শসা ভক্ষণের মধ্য দিয়ে সন্তানধারণের আকাঙ্ক্ষা ও সন্ততিকে বালাই থেকে দূরে রাখার কামনা যেমন থাকে; তেমনি থাকে শুভকে নিরন্তর জাগিয়ে রাখার প্রয়াস। আর এভাবেই এগিয়ে চলে 'জিতাষ্টমী ব্রত'পালনের ঐতিহ্য...







এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...