মাত্র দশ বছর বয়সে নির্বাক ছবি 'জয়দেব' এ অভিনয় করে পাঁচ টাকা সম্মানী পেয়েছিলেন। তখনও জানতেন না জীবনের স্রোত তাঁকে কোন দিকে ধেয়ে নিয়ে যেতে চলেছে, তখনও জানতেন না ঊনিশ শতকের বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কিংবদন্তী তারকাদের মধ্যে অন্যতম নাম হিসেবে তাঁর নামও স্বমহিমায় হয়ে উঠবে উজ্জ্বল। তিনি কানন দেবী, বাংলা সিনেমার প্রথম মহিলা 'সুপারস্টার'। ১৯১৬ সালের ২২ মে অর্থাৎ আজকের দিনেই জন্মগ্রহন করেন তিনি, আজ তাঁর ১০৩ তম জন্মদিন।
নানান সময়ে নানান খাতে প্রবাহিত হয়েছিল তাঁর জীবন, একজন 'সুপারস্টার'-এর বর্ণময় জীবনের মতোই। অত্যন্ত দুঃস্থ পরিবার-পরিবেশে জন্ম এবং শৈশবকাল কাটে তাঁর। অভিনয়, কন্ঠ, ব্যক্তিত্ব, সহ্যক্ষমতা, নির্ভীকতা, সহমর্মিতা - এগুলি তাঁর ছিল বলেই জীবনের লজ্জা-লাঞ্ছনা-অপমান-ক্লেশ যাবতীয় প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে তিনি সেযুগেও তৈরী করে নিতে পেরেছিলেন নিজের সুদীপ্ত পরিচিতি।
সংশয় নেই, জীবন বোধে উজ্বল ছিল তার দীর্ঘ শিল্পী ও সামাজিক জীবন। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ছেষট্টি বছর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাঁর নাম। শুধু অভিনয় ও সংগীত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এমন নয় প্রযোজনা, পরিচালনা, বিচারক মন্ডলী, ডিরেক্টর বোর্ড, সিনেমা'র প্রতিটি বিভাগের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন সুদীর্ঘ সময়।
তাঁর মুখ দেখা যেত বড় বড় ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনেও।
দুস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে গঠন করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। যুক্ত ছিলেন সামাজিক নানান কল্যাণকর সংগঠনের সঙ্গে।
কাননবালা হাওড়ার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রতন চন্দ্র দাস এবং মা রাজবালা দেবী। তবে জানা যায়, রাজবালা ছিলেন রতন চন্দ্র দাসের রক্ষিতা, বিবাহিত পত্নী নন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় কাননবালা দেবীর জনপ্রিয় আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় কাননবালা দেবীর বহুল পঠিত ও জনপ্রিয় আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’। জীবনী থেকেই জানা যায় তাঁর জীবনের কঠোর পরিশ্রম, একনিষ্ঠ সাধনা, একাগ্রতার কথা। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসায় জীবনের সিংহভাগই তাঁর কেটেছিল শারীরিক-মানসিক লাঞ্ছনা গঞ্জনা হজম করে। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে মনপ্রান ঢেলে করে যেতে চেয়েছিলেন নিজের কাজগুলো, যে কাজগুলোই হয়ে উঠেছিল তাঁর আত্মসম্মান, আত্মগরিমা।
১৯৬৪ সালে ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে সম্মানিত করেন কানন দেবীকে। তারপর ১৯৭৬ সালে পান চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার । ১৯৯২ সালে ছিয়াত্তর বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যু হয় তাঁর। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করে। সবকিছু নিয়ে প্রদীপের আলোর মতই উজ্জ্বল ছিল তাঁর উপস্থিতি, তাঁর কাজ আর... অন্ধকার টুকু ছিল তাঁর জীবন।