গোয়েন্দা বলতে কেমন ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনে! এক আদ্যোপান্ত গম্ভীর মানুষ। তুখোড় বুদ্ধিধারী। ভীষণ জ্ঞানী। যার মুখের হাসি দেখার সৌভাগ্য হয় রহস্য সমাধান করলে। গোয়েন্দার মগজাস্ত্রটি নানান জটিল, গুরুতর এবং তীক্ষ্ণ চিন্তায় ভরা। গোয়েন্দার মনোরঞ্জন বলতে শুধুমাত্র রহস্য সমাধানের সূত্রের প্রাপ্তি। সাধারনত এই বৈশিষ্ট্যগুলোকেই গোয়েন্দা চরিত্রের অন্যতম দিক বলে ধরে নেওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যেও তেমনি দেখা মেলে গোয়েন্দাদের। কিন্তু একজন গোয়েন্দা যদি হয় বুদ্ধিমান, জ্ঞানী কিন্তু একেবারেই গম্ভীর থাকতে পারেন না, যিনি নিজেকে নিয়ে মজা করতে ভালোবাসেন। এছাড়াও নিজের চারপাশের নানা পরিবেশ-পরিস্থিতি এমনকি বিভিন্ন মানুষের মধ্যে থেকেও খুঁজে নেন মজার উপাদান। শুধু তাই নয় কোন বিষয়ে নিজের অপারগতা প্রকাশ করতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন না এই গোয়েন্দা । কোন বিষয়ে শখ আছে, অথচ দক্ষতা নেই সেটাও অবলীলায় স্বীকার করেন সকলের সামনে। এমনই এক গোয়েন্দা পরাশর বর্মা। সৃষ্টিকর্তা প্রেমেন্দ্র মিত্র। যাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে তিনি নম্র এবং একেবারেই অহংমুক্ত। এই গোয়েন্দার সঙ্গে সময় কাটালে শুধু মগজাস্ত্রকেই খানিক উন্নত করে নেওয়া হয় না, মন ঝরঝরে হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে পরাশর বর্মা এমনই এক অন্যরকম রহস্যসন্ধানীর নাম।
সৃষ্টিকর্তা সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র পরাশর বর্মাকে গড়ে তুলেছেন একেবারে অন্যরকম ভাবে। বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞান ছাড়া তাঁর বাকি সমস্ত বৈশিষ্ট্যই ঠিক গোয়েন্দাসুলভ নয়। যেমনটা আমরা সচরাচর গোয়েন্দাদের ক্ষেত্রে কল্পনা করে থাকি আর কি। সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই পরাশর বর্মা রহস্য সমাধান করার ক্ষমতা রাখলেও হলেও, তাঁর ইচ্ছে কবি হওয়া। লেখকের গল্প অনুযায়ী এই কবিত্বয় তাঁর বিশেষ পাণ্ডিত্য নেই, অথচ এই কবিতা রচনা করতে করতেই নিমেষে সমাধান করে ফেলেন রহস্যের। ১৯৩২ সালে প্রথম পরাশর বর্মা গল্পগুলো প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। প্রথম আবির্ভাব "গোয়েন্দা-কবি পরাশর" গল্পে। পরাশর নিজেকে কখনোই গোয়েন্দা হিসেবে কল্পনা করেন না। তাঁর শখ লেখালিখি। বিশেষ করে কবিতা লেখা। সৃজনশীলতার হাত ধরে তিনি সমাধান করেন রহস্যের। গোয়েন্দা হিসেবে পরাশর বর্মা স্বতন্ত্র। তবে এক জায়গায় তিনি বাকি গোয়েন্দাদের মতই। তাঁর তুখোড় বুদ্ধি। তাঁর মগজাস্ত্র এতটাই তীক্ষ্ণ যে, কবিতা আওড়াতে আওড়াতেই রহস্য সমাধান করে ফেলেন। ঘনাদাও প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্টি। কমিক চরিত্র। বুদ্ধিমান এবং রহস্য সমাধানকারী। ঘনাদা মূলত শিশু-কিশোর পাঠকদের জন্য। পরাশর বর্মার গল্পগুলো যেকোনো বয়সের পাঠকদেরই আকৃষ্ট করে। পরাশর বর্মার দুটো গল্প ঘনাদা এবং পরাশর বর্মার সাক্ষাৎ হয়েছে।
এই গল্পগুলোর কথক কৃত্তিবাস ভদ্র। ইনি পরাশর বর্মার বন্ধুস্থানীয়। একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক। এই গোয়েন্দার ভীষণ ইচ্ছে তাঁর কবিতাগুলো ছাপা হবে সেই ম্যাগাজিনে। কৃত্তিবাস ভদ্রের মতে পরাশর বর্মা নিঃসন্দেহে একজন জিনিয়াস মানুষ। তবে তাঁর শিল্পকীর্তি নিয়ে সন্তুষ্ট নন এই ম্যাগাজিনের সম্পাদক। কথায় আছে নিজেকে নিয়ে মজা করতে পারাও একটা শিল্প। তেমনই শিল্পী মানুষ পরাশর বর্মা। কৃত্তিবাস ভদ্রও বেশ কিছু গল্পে এই গোয়েন্দাকে নিয়ে নিয়ে মজা করেছেন। অর্থাৎ মজার ছলে নানা রহস্য এই গোয়েন্দাকে দিয়ে সমাধান করিয়ে নিয়েছেন স্বয়ং লেখক। পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় প্রেমেন্দ্র মিত্রের গোয়েন্দা সাহিত্য। সে ঘনাদা হোক বা পরাশর বর্মা। মিত্র এবং ঘোষ প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় পরাশর বর্মার গল্পগুলো বই আকারে। জীবনের যেকোনো টালমাটাল অবস্থায় এই ধরনের সাহিত্য শুধুমাত্র মনোরঞ্জনই করে না, বরং জীবনকে সামলে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ নেওয়ার বার্তা দেয়।