সত্যজিৎ রায়ের দার্জিলিং জমজমাট গল্পে তুখোড় ক্রিমিনালের পাল্লায় পড়ে ফেলুদা একবার বলেছিল "গোয়েন্দাগিরিটা এবার ছেড়ে দেব তোপসে"। ফেলুদার মত বুদ্ধিমান দুঁদে গোয়েন্দার মুখে এহেন কথায় পাঠকদের মনে কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
ফেলুদা গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দিলে আমার-আপনার কখনো তোপসের মত করে বা কখনো লালমোহনবাবুর মত করে কথা বলার সুযোগ হত না। ফেলুদার কাঁধে ভর দিয়ে কল্পনায় গোয়েন্দার আগেই নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে রহস্যগুলো সমাধান করার অপার্থিব আনন্দের অনুভুতি হত না। এমন সারল্যে ভরা কিছু অনুভূতি ভাগ্যিস ফেলুদা স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় আমাদের উপহার দিয়েছেন। তাই আমাদের ছোটবেলা নস্ট্যালজিক হয়ে আছে ফেলুদাকে ঘিরে।
মগনলাল মেঘরাজের মত ক্রিমিনালদের মস্তিষ্ক যুদ্ধে পরাস্ত করেছে ফেলুদা। ফেলুবাবুকে মিষ্টি কথার প্যাঁচে ফেলে বিপদের জালে আবদ্ধ করতে মগনলাল মেঘরাজের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর আর ফেলুদার বাকযুদ্ধে কল্পনায় ভর করে আমরাও কতবার পৌঁছে গেছি সেই পরিস্থিতিগুলোতে, গোয়েন্দাকে কুর্নিশ জানাতে। বাংলা সাহিত্য ভান্ডার রত্নখচিত। মণিমাণিক্যে ভরা। নানা অনুভূতি থরে থরে সাজানো সেখানে। মনের সব দুয়ার বন্দি কোনগুলোকে স্পর্শ করার ক্ষমতা আছে বাংলা সাহিত্যের। তবে মনের পথ অতিক্রান্ত হয়ে মস্তিষ্কের অলিগলি ঘুরে আসার সাহিত্য হল রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনী।
এ বিষয়ে যাঁর নাম সর্বপ্রথম মনে আসে তিনি অবশ্যই সত্যজিৎ রায় এবং তার শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা। অর্থাৎ প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। নিজের ছোট ভাই তপেশ রঞ্জন মিত্রকে সহযোগী করে একের পর এক কেস তুড়ি মেরে সমাধান করেছেন এই গোয়েন্দা। সত্যজিৎ রায়ের বলিষ্ঠ লেখনীতে এই চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে জীবন্ত। "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি" গল্পে প্রথম আবির্ভূত এই গোয়েন্দা তাঁর ইন্দ্রজালের জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন "রবার্টসনের রুবি" গল্প পর্যন্ত। মোট পঁয়ত্রিশটি গল্পের মধ্যে "রবার্টসনের রুবি" শেষ প্রকাশিত গল্প। "আদিত্য বর্ধনের আবিষ্কার" ও "তোতা রহস্য"এই দুটি "অসমাপ্ত ফেলুদার" অন্তর্ভুক্ত। স্রষ্টা এগুলো শেষ করে যেতে পারেননি।
জয় কৃষ্ণ মিত্রর পুত্র প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের ২১ রজনী সেন রোডের কাল্পনিক বাড়ি যে বাস্তবের কত ফেলুদা হতে চাওয়া কিশোরের স্বপ্নের ঠিকানা তার সংখ্যা হিসেবের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়। ফেলুদা সাহিত্যের কথক তপেশ রঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে। ফেলুদা তোপসের জেঠতুতো দাদা। আমরা কোনো ভালো কাজ করলে কেউ যদি পিঠ চাপড়ে "সাবাশ তোপসে" বলে একবার, এই প্রশংসাবাণী যেকোনো উপহারের থেকেও মূল্যবান। ফেলুদা সিরিজের ষষ্ঠ গল্প "সোনার কেল্লা" থেকে রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলীর আবির্ভাব হয়েছে। তারপর থ্রি মাস্কেটিইয়ার্সের তিন অমূল্য রতনেরা একসঙ্গে মিলে লেখকের সৃষ্টির হাত ধরে জন্ম দিয়েছেন অতুলনীয় সাহিত্যের।
১৯৬৫ সালে প্রথমবার সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ফেলুদার গল্পগুলো আজও আমাদের স্মৃতিতে অমলিন। শুধু বইয়ের পাতাতে থেমে থাকেনি ফেলুদার যাত্রাপথ। এ সাহিত্য সৃষ্টি করেছে কালজয়ী সিনেমা। "জয় বাবা ফেলুনাথ", "সোনার কেল্লা", "বাক্স-রহস্য", "বোম্বাইয়ের বোম্বেটে", "বাদশাহী আংটি"র মত মাইলস্টোন বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায়ের হাত ধরেও। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে বর্তমান প্রজন্মের আবীর চট্টোপাধ্যায়, ফেলুদার চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ যে এই অভিনেতাদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন সকলেই।
অনেক গবেষকের মতে, ছয় ফুট উচ্চতার এই কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্রে লেখক নিজেরই ছবি এঁকেছেন। ফেলুদা সিরিজের বইয়ের প্রচ্ছদে যে ছবি আমরা দেখি তা লেখকের নিজের আঁকা এবং সেই ছবি তার নিজের যুবা বয়সের ছবির সঙ্গে অনেকাংশেই মেলে। ফেলুদার মধ্যে দিয়ে লেখকেরই বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছে সাহিত্যমহল এমনটাই মনে করে। ফেলুদার রহস্য সমাধানের পথ সরল। অপরাধের আশেপাশে লেগে থাকা ক্লু জুড়ে জুড়ে সমাধানসূত্র অবধি পৌঁছে যাওয়া, এটাই মূল মন্ত্র।
তারপর মগজাস্ত্র দিয়ে অপরাধীকে ঘায়েল করা। ফেলুদা সিরিজকে কিশোর সাহিত্য বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের কাছেই ফেলুদার আকর্ষণ একইরকম দ্যুতিময়। ফেলুদা চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা শার্লক হোমস তা গল্পেই বর্ণিত হয়েছে। "লন্ডনে ফেলুদা" গল্পে শার্লক হোমসের বেকার স্ট্রিটের বাড়ির উদ্দেশে ফেলুদা প্রণাম জানিয়েছেন। ফেলুদার গল্প নারীবর্জিত। ফেলুদার দুর্দান্ত আইকিউ, তোপসের বুদ্ধিদীপ্ত সারল্য, লালমোহন বাবুর মজার কান্ড-কারখানা, সিধু জ্যাঠার জাজ্জ্বল্যমান উপস্থিতি এই অনন্য সাহিত্য সৃষ্টিকে অন্য মাত্রায় উপনীত করেছে। ফেলুদা সাহিত্যে গোয়েন্দাগিরির স্থানগুলোর দর্শনীয় জায়গা ও খাবার-দাবারেরও বর্ণনা পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে ফেলুদা সাহিত্য সরলতায় মাখানো 'সব পেয়েছির দেশ'। আর ফেলুদা থাকতে আমাদের ছোটবেলা চুরি করার সাধ্য কোনো 'দুষ্টু লোকের' নেই।