সাহিত্যে গোয়েন্দা: কর্নেল নীলাদ্রি সরকার

বয়স। অনেক কিছুরই মাপকাঠি নাকি শুধুই সংখ্যা। কিছু মানুষ কোন বিষয়েই বয়সকে বাধা হিসেবে দেখেন নি। বয়স, পরিস্থিতি, পরিবেশ সবকিছুর চোখরাঙানিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে কেবলমাত্র ভালবেসেছেন জীবনকে। জীবন নামের নীলকন্ঠ পাখিকে। বয়স নামের এই সংখ্যাটা হার মেনেছে তাঁদের কাছে। তেমনি এক গোয়েন্দা কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। অবশ্যই কাল্পনিক। সৃষ্টিকর্তা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। নীলাদ্রি সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক রিটায়ার্ড অফিসার। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন কল্পনা আর বাস্তবের মিশ্রণে। নীলাদ্রি সরকারকে দেখতে স্যান্টা ক্লজের মত। স্যান্টা ক্লজ মানেই শুভবুদ্ধির জয়, এবং আশাপূরণ। নীলাদ্রি সরকারও রহস্য সমাধানের মাধ্যমে দুষ্টের দমন করে শুভবুদ্ধির বার্তা নিয়ে এসেছেন গল্পগুলিতে।

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ। নিজের শখ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি নিজেকে প্রকৃতি বিশারদ হিসেবে পরিচয় দেন। প্রজাপতি সংগ্রহ করেন এবং একজন অর্নিথলজিস্ট বা পক্ষী বিশারদ। পাইপের ধোঁয়ায় শান দেন নিজের মগজাস্ত্রকে। বুদ্ধিমান মানুষদের সঙ্গে কি কফির যোগ থাকে? কর্নেল নীলাদ্রির খুব প্রিয় কফি। কফির চুমুকে রহস্যের জাল ভেদ করার ছবি আঁকেন এই গোয়েন্দা। অবশ্যই নিজের মস্তিষ্কে। মানসলিখনের মত মানসসমাধান। এই গল্পগুলির কথক দৈনিক "সত্যসেবক" পত্রিকার একজন অলস সাংবাদিক। জয়ন্ত। জয়ন্ত নানান অভিযানেও সঙ্গ দেন কর্নেলকে। জীবনের নির্দিষ্ট কোনো প্রান্তে পৌঁছেও জীবনের বিস্তৃতি দেখা যায়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের এই গোয়েন্দা গল্পগুলো তারই সমার্থক। একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার কে. কে. হালদারও বেশ কিছু গল্পে সঙ্গ দিয়েছেন কর্নেলকে। কর্নেল পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন। লুপ্তপ্রায় বাংলা প্রবাদ বাক্য ও ছড়া তাঁর বড় প্রিয়। স্ব-অর্জিত পন্থায় তিনি সমাধান করেন রহস্য। রহস্যের প্রয়োজনে তাঁরা পাড়িও দিয়েছেন নানা জায়গায়। কৌতুহলী এই সাদা চুলের বৃদ্ধটি অকুতোভয়। শত্রুদের ঘায়েল করার ক্ষমতা রাখেন বুদ্ধির জোরে। বাংলা সাহিত্যে এই বয়সের এমন বুদ্ধিমান গোয়েন্দার দৃষ্টান্ত কমই আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের মনে তিনি স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন।

১৯৭০ সালে প্রথম অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের গল্প। তারপর লেখক প্রায় ১০০টির ও বেশি গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন নীলাদ্রি সরকারকে নিয়ে। এই গোয়েন্দার প্রথম আবির্ভাব হয় "ছায়া পড়ে" গল্পতে। শেষ আবির্ভাব "হু হুম্বা রহস্য"তে। গল্পগুলো প্রধানত কিশোর এবং যুবা বয়সের জন্য লেখা হলেও যে কোনো বয়সের পাঠককেই আকর্ষণ করে এই বুদ্ধিমান বুড়োর গল্প। স্বাভাবিকভাবেই লেখকের অকালপ্রয়াণের পর থেমে যায় তাঁর সৃষ্টি। কিন্তু সাদা চুলের স্যান্টা ক্লজের মতই এই বৃদ্ধটির বুদ্ধি এবং তাঁর জীবন দর্শন আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে বরাবর। সাহিত্যের সার্থকতা বোধহয় এখানেই। চরিত্ররা বইয়ের পাতা থেকে আমাদের জীবনবোধকে উদ্দীপিত করে। চিন্তা ভাবনায় এগিয়ে দেয়। আর সময়ের আগেই চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাসম্পন্ন লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের এই অমর সৃষ্টি পাঠক মনকে জয় করে নিয়েছে অনায়াসেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...