আজকালকার শিশুদের অন্যতম প্রিয় কার্টুন চরিত্র হল ছোটা ভীম, আবার বাঙালির ছিল ভীম ভবানী। কিন্তু মহাভারতের ভীমও বাঙালির বড্ড প্রিয়। ভীমসেন, মধ্যম পান্ডবের পুজোও করে বাঙালি। কথায় বলে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন। দুর্গা পুজো, কালী পুজো, সরস্বতী পুজো যেমন রয়েছে, তেমনই বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সময়ে সারা বছরেই চলতে থাকে নানান পুজো। তেমনই হল পূর্ব মেদিনীপুরের ভীমপুজো। প্রাচীনকাল থেকে ভীমপুজো চলে আসছে পূর্ব মেদিনীপুরে। ভীমদেবের পুজোপাঠ হয় প্রতি বছরই। ভীম চতুর্দশীতে ভীম পুজোয় ব্রতী হয় তমলুকের তাড়াগেড়িয়া থেকে কুলবেড়িয়া এবং মহিষাদলের আন্দুলিয়া, বাসুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায়। সাতদিন ধরেই চলে নানা অনুষ্ঠান ও মেলা। ভীমকে কোথাও কোথাও চাষের দেবতা মনে করা হয়। আবার কোথাও কোথাও শক্তির দেবতা হিসেবেই ভীমের পুজোপাঠ হয়। মনস্কামনা পূরণের জন্য পুজো দেওয়া, পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ারও রীতি মানা হয় পুজো মণ্ডপ গুলিতে। দৈত্যাকার ভীম ঠাকুর দেখতেও মানুষের ভিড় বাড়ে, বিপুল জনসমাগম হয়। উৎসাহও থাকে নজরকাড়া। ভীম ঠাকুরের মূর্তির উচ্চতাই বাড়তি আকর্ষণের কারণ; কোথাও উচ্চতা ২৫ ফুট, কোথাও আবার ৩০ ফুটের ভীম। বিশাল সব উচ্চতা সম্পন্ন ভীম ঠাকুরের গলায় থাকা লম্বা লম্বা মালায় ঢেকে যায় ভীমদেবের শরীর। উঁচু উঁচু ভীমের গলায় থরে থরে সাজানো অবস্থায় ঝুলতে থাকে অসংখ্য টাকার মালা। আবার বাতাসার মালাও পরানো হয়।
দুর্বাচটি নদী পেরিয়ে ঘাটগোড়া এলাকায় দত্যিদানোর মতো প্রকান্ড ভীমের পুজো হয়। এখানে ভীম আরাধনা হয় ভীম একাদশী তিথিতে। সেই উপলক্ষ্যেই বিশালাকার মূর্তি তৈরি করা হয়।মাঘ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের একাদশী তিথিতে রাঢ়বঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় ভীম ঠাকুরের পুজোর প্রচলন আছে। মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে ঘট স্থাপনের মাধ্যমে এই পুজোর আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। লোকজ ছড়ায় রয়েছে, সব করেছে যোশী / বাকি আছে ভীম একাদশী। দক্ষিণ বঙ্গে একাধিক জায়গায় ভীমের আরাধনা করা হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের টেরাগেড়া গ্রামের তিনশো বছরের ভীম মেলা ও ভীমপুজোর ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অনন্য নজির। পশ্চিম মেদিনীপুরেও ভীমের পুজো হয়। হাওড়া জেলার শ্যামপুরের রাধাপুরে ভীমের পুজো ও মেলা শতাব্দী প্রাচীন। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক শহরের লাগোয়া কুলবেড়িয়া গ্রামে ভীমপূজা উপলক্ষ্যে ভীম মেলা বসে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই মেলা ১২০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। বাংলাকে যতই পান্ডববর্জিত দেশ বলা হলেও, মধ্যম পান্ডবের প্রতি বাংলা বহুদিন ধরেই শ্রদ্ধা বৎসল।
মেদিনীপুরে ভীমের নানা কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে। গড়বেতার গনগনির ডাঙার জীবশ্ম হতে বসা গাছের পাথুরে কাঠামোকে লোকে বলে বকরাক্ষসের পাঁজর। কোনওটা আবার ভীমের প্রদীপ। বহুকাল আগে এই অঞ্চলের নাম ছিল বগড়ী পরগণা। বগড়ী এসেছে বক্ ডিহি থেকে, অর্থাৎ বক রাক্ষসের ডাঙা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, গনগনির ডাঙাতেই হয়েছিল ভীম আর বকরাক্ষসের তুমুল মল্লযুদ্ধ। শীলাবতীর ওপর পাড়ে রয়েছে একচরা গ্রাম। কেউ কেউ বলেন, এই একচক্রা গ্রামে পঞ্চপান্ডব অজ্ঞাতবাস কালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মেদিনীপুর শহর ছাড়িয়ে রয়েছে, রাঙামাটির প্রান্ত গোপগড়। কিংবদন্তী অনুযায়ী, এই গোপগড়ই হল বিরাট রাজার রাজধানী। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এই রাজ্যে ছদ্মবেশে থাকার সময় ভীমসেন কীচককে হত্যা করেছিলেন।
মেদিনীপুরের মাটি ঘিরে মল্লবীর ভীমের আরও একটি বিখ্যাত কাহিনী রয়েছে, মহাবীর ভীমের মহোত্তম প্রেমকাহিনীও শোনা যায়। খড়্গপুরের খড়্গেশ্বর মন্দিরের অদূরেই আছে হিড়িম্বেশ্বরীর মন্দির। মনে করা হয়, একদা এই অঞ্চলের ভূমিপুত্র ছিল মেদ জাতির মানুষেরা। কিংবদন্তী অনুযায়ী, এক সময় মেদ জাতির মানুষদের থেকেই মেদিনীপুর নামের সৃষ্টি হতে পারে। মেদ জাতির ভালোবাসার মানুষ ভীমসেনও তাঁর ভক্তদের মতোই ছিলেন উদার, সরল আর মহাবলশালী। এই ভীম তাঁদের কাছে কৃষক বা হালুয়া ভীম, ক্ষেত্রী ভীম বা হুলা ভীম। কৃষিজমির তথা ফসল রক্ষক হিসেবে তাঁরা ভীমের উপাসনা করেন, আবার রোগব্যাধি নিরসনেও ভীমের স্মরণাপন্ন হন। নন্দকুমারে ভীমের স্থায়ী মন্দিরে পুজো দিতে আসেন মানুষ। অন্য একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী, পূর্ব মেদিনীপুরের বণিক সমাজের চোখে ভীম পবনপুত্র। নদী সমুদ্র পথে বানিজ্য বায়ু নির্ভর ছিল। পবনপুত্র ভীম ছিলেন তাঁদেরও ত্রাতা। ভুললে চলে না একসময় সমুদ্র বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল মেদিনীপুর। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলত।
ভীম একাদশীর কথায় আসি, দিনটিতে নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করা হয়। কথিত আছে, মহর্ষি বেদব্যাস ভীমসেনকে ওইদিন নির্জলা ব্রত করার উপদেশ দেন। ওই ব্রত করলে, সারা বছরের সমস্ত একাদশী ব্রতের ফল একটি মাত্র ব্রতেই পাওয়া যায়। ব্রত মূলত মেয়েদের আচার। সেখানে একজন পুরুষ হিসেবে ভীমের নির্জলা ব্রত পালন ব্যতিক্রমী। ভীম একাদশী ব্রতের আরও একটি কাহিনী শোনা যায়। সকালে শীতল জলে অবগাহন করে ভীমের মা কুন্তিকে একাদশী করতে হয়। শীতে কাতর হয়ে যাওয়া মাকে দেখে, ভীম রেগে, লাঙলের ফাল গরম করে জলে চোবাতে লাগলেন। অচিরেই জল উত্তপ্ত হয়ে উঠল। গরম জলে স্নান করে কুন্তি খুবই তৃপ্ত হলেন। অপরদিকে জলের উত্তাপ বেড়ে বরুণদেবের শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেল। বরুণদেব শ্রীকৃষ্ণের স্মরণাপন্ন হলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে পরামর্শ দিলেন ভীমকে বোঝানোর। ভীম যদি এই একাদশীতে ব্রত পালন করেন তাহলেই বরুণদেবের গাত্রদাহ কমবে। বরুনদেব ভীমকে সম্মত করতে সমর্থ হলেন। সেই থেকেই এই একাদশীর নাম হল ভীম একাদশী।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তমলুক ব্লকের কুলবেড়িয়া গ্রামে শতাব্দী প্রাচীন কাল ধরে চলে আসছে ভীম ঠাকুরের পুজো। কুলবেড়িয়া গ্রামের ভীম মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল বাংলার ১৩০৫ সন। কুলবাড়িয়া গ্রামের ভীমপুজো নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যায়। একটি মতে, গ্রামে কোনও পুজোর প্রচলন ছিল না। অন্যান্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের অন্যান্য দেবদেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। এই গ্রামেরই সম্ভ্রান্ত উচ্চবিত্তশীল ব্যক্তি কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ সর্বপ্রথম ভীম পুজো বা বীর পুজোর প্রচলন করে। কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ এর দেখাদেখি সেই সময় আরও একটি ভীম পুজো শুরু হয় কুলবেড়িয়া গ্রামে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই দুটো পুজো একত্রিত হয়ে যায়। কুলবাড়িয়া গ্রামের ভীম পুজো নিয়ে আরেকটি প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী, ১২৬ বছরের আগে পশুদের মৃতদেহ ফেলার স্থানে পুজো শুরু করেছিলেন কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ। পশুদের মৃতদেহ ফেলার স্থানে অন্যান্য দেব দেবীর পুজো হতে পারে না। তাই ভীম ঠাকুরের পুজো করেছিলেন তিনি। ওই এলকায় পশুদের মৃতদেহ ফেলার কারণে প্রচুর সংখ্যক শকুন বাস করত, ফলে চারিদিকে নোংরা আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ত। তা থেকে মুক্তি পেতেই ভীম পুজোর প্রচলন হয়। তিথি ও পঞ্জিকা অনুসারে কুলবাড়িয়া গ্রামের পুজোর ঘট স্থাপন হয়। নিঃসন্তান দম্পতি ও সন্তানের মঙ্গল কামনায় পিতা মাতারা ভীম ঠাকুরের কাছে মানত করেন। তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে ভীম ঠাকুরের ব্রত রেখে পুজো দেন। এই পুজো দেওয়া নিয়ে আর এক অন্যরকম রীতি রয়েছে।
ভীম ঠাকুরের ঘট স্থাপনের জন্য যে পুকুরে যাওয়া হয়, সেই পুকুরে ঘট ডোবানোর সঙ্গে সঙ্গে ভীম ঠাকুরের ব্রতীরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে স্নান করে ভিজে অবস্থায় মন্দিরে আসে এবং মন্দিরের চারপাশে দণ্ডী কাটে। ব্রতীরা ছোট ছোট পুতুল অর্পণ করে ভীম ঠাকুরের পুজো দেন। ভীম ঠাকুরের পুজো উপলক্ষে কুলবেড়িয়া গ্রামে এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে বাড়িতে নিরামিষ খাওয়া রান্না হয়। এমনকি পুজো উপলক্ষ্যে যে মেলা বসে, সেই মেলাতেও আমিষ খাবার দাবারের স্টল বা দোকান থাকে না। আজ প্রায় ১২৫ বছর ধরে কুলবেড়িয়া ভীম পুজো করে চলেছে।