বিশ্বকর্মা ও তার দুই পুত্র নল, নীলের আরাধনা

আজ ভাদ্র সংক্রান্তি। এই দিনটি বরাবর বাঙালির কাছে দুর্গা পুজোর আগমনীবার্তা নিয়ে আসে, কারণ বিশ্বকর্মা পুজো মানেই মা আসার দিন গোনা শুরু। দেবতাদের শিল্পী তিনি। তিনি নির্মাণ, যন্ত্রপাতির আদি দেবতা। ঋগ্বেদের বিশ্বকর্মা ছিলেন বৃদ্ধ, বাংলায় এসে যুবক হয়েছেন। একেবারেই কার্তিক ঠাকুরের মতোই তার চেহারা। এক সময়ে তিনি ছিলেন দেবতাদেরই এক জন। আজ তিনি দেবশিল্পী! রাজহাঁসের বদলে আজ তার বাহন হয়েছে হাতি। বিশ্বকর্মা। স্বর্গের অনান্য দেবতা দের মতো তাঁরও পূজা হয়।

বিশ্বকর্মার ধ্যান মন্ত্রে রয়েছে,

"ওঁ বিশ্বকর্মন্ মহাভাগ সুচিত্রকর্মকারক্।
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক্ ত্বঞ্চ রসনামানদণ্ডধৃক্।।''
আবার প্রণাম মন্ত্র বলছে,
বিশ্বকর্মার প্রনাম মন্ত্রে বলা হয়,
''দেবশিল্পী মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক।
বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক।।"

'মণ্ডনসূত্রধারে' বিশ্বকর্মার রূপ বর্ণনা পাওয়া যায়-
''বিশ্বকর্মা চতুর্বাহুরক্ষমালাঞ্চ পুস্তকম্
কম্বাং (ম্বং) কমণ্ডলং ধত্তে ত্রিনেত্রৌ হংসবাহনঃ।।''

অর্থাৎ বিশ্বকর্মা চতুর্ভুজ, তার হাতে রয়েছে পুস্তক, অক্ষমালা, শঙ্খ এবং কমণ্ডলু। তিনি ত্রিনেত্রযুক্ত ও হংস বাহনারূঢ়। এক অন্য বিশ্বকর্মার মাথায় মুকুট। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বকর্মার হাতে দাঁড়িপাল্লা, হাতুড়ি, বিভিন্ন যন্ত্র, কাস্তে প্রভৃতি দেখা যায়। তিনি গজপৃষ্ঠে আরোহণকারী রূপ নিয়ে বিরাজমান। ভারতে নানা প্রান্তে নানান সময়ে বিশ্বকর্মার পুজো হয়। দক্ষিণ ভারতে পুজো হয় মহানবমীর দিন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দিওয়ালির পরের দিন প্রতিপদে বিশ্বকর্মা পুজো হয়। বাংলায় এই পুজো হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে। কেউ এদিন ঘুড়ি ওড়ায়, কেউ কেউ রান্না পুজোয় মেতে ওঠে।

বেদ পরবর্তী যুগেই তিনি হয়ে উঠলেন দেবশিল্পী, সত্যযুগে গড়লেন স্বর্গ, ত্রেতায় রাবণের স্বর্ণলঙ্কা, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা এবং পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ। পুরান বলে বিশ্বকর্মার পিতা হলেন অষ্টবসুর অন্যতম প্রভাস। বিশ্বকর্মার মাতা হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী বরবর্ণিনী। আবার ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান বলে ব্রহ্মার নাভি থেকে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। বিশ্বকর্মাকে নিয়ে কিংবদন্তি, শাস্ত্র, বেদের ব্যাখ্যার শেষ নেই। তবে বিশ্বকর্মার সঙ্গে আরও দুজন থাকতেন।

বিশ্বকর্মার চার হাত আর সঙ্গে বাহন হাতি দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু সেকালের কলকাতায় একসময় বিশ্বকর্মার সঙ্গে তাঁর দুই পুত্রের দেখাও পাওয়া যেত। দুই পুরুষরূপী দেবতা, কিছু বছর আগেও কলকাতায় ও গ্রামবাংলায় একই সঙ্গে তিন জনের মূর্তি দেখা যেত। মাঝে বিশ্বকর্মা আর দুপাশে দুই ছেলে। বাংলা পুরাণমতে বিশ্বকর্মার দুই ছেলের নাম ছিল নল ও নীল। দু-জনেই বাবু গোছের। যদিও বিশ্বকর্মার দুই পুত্র ছিল দুই বানর।

এমনিতেই বাংলার বিশ্বকর্মার সঙ্গে পৌরাণিক বিশ্বকর্মার কোন মিল নেই। বৃদ্ধরূপী বিশ্বকর্মা বাংলার বাইরে সর্বজনবিদিত। তেমনই কয়েকটি তথ্য প্রমাণ বলে বিশ্বকর্মা পাঁচ পুত্রের জনক। আবার বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞার কথাও জানা যায়। সংজ্ঞার স্বামী ছিলেন সূর্যদেব। বিশ্বকর্মার দুই বানররূপী পুত্র নল ও নীলের কথা রামায়ণে পাওয়া যায়। এ নিয়েও ভিন্ন মত রয়েছে, কেউ কেউ বলেন নীল অগ্নিদেবের পুত্র। নলের গায়ের রঙ ছিল শ্বেত পদ্মের মতো। নীলের গায়ের বর্ণ ছিল নীল। রামায়ণ বলে, রাবণকে দমন করতে বিষ্ণু রাম অবতারে জন্মগ্রহণ করেন। তেমনই ব্রহ্মার নির্দেশে রাবণ বধে রামের সাহায্যার্থে বানররূপে অন্য দেবতারাও জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বকর্মা, অগ্নি, বায়ু সবাই বানররূপে জন্ম নেন। নল ও নীলের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। বলা হয়, এক বানরীর রূপ যৌবনে মত্ত হয়েছিলেন বিশ্বকর্মা। বানরীর গর্ভজাত ও বিশ্বকর্মার ঔরসজাত দুই সন্তান হলেন নল ও নীল। বানর হয়ে জন্মালেও দুই ভাই স্থাপত্যশিল্পে বিশ্বকর্মার মতোই পারদর্শী ছিল।

নল আর নীল খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। দেবতাসহ মুনি ঋষিদের জিনিসপত্র খেলার ছলে দুই ভাই ছুঁড়ে সাগরে ফেলে দিত। বালক বলে তাদের বারবার ক্ষমা করে দিতেন মুনিঋষিরা। কিন্তু নল-নীলের এহেন আরচরণ ক্রমেই বেড়ে চলল। একদিন এক ঋষির পুজোর সামগ্রী নল-নীল সাগরে ফেলে দিয়েছিল। সেই ঋষি দুই বালককে অভিশাপ দেন, অভিশাপ দিয়েছিলেন তারা কোনও জিনিস সাগরে ফেললেও তা ডুববে না, ভেসে উঠবে। যাতে মুনি-ঋষিরা জলে ফেলে দেওয়া জিনিস সহজেই খুঁজে পান তাই এমন অভিশাপ দিয়েছিলেন ওই ঋষি। কিন্তু শাপে বর হল। তারাই পরে বানর বাহিনীতে যোগ দিন।

বানর বাহিনীতে হনুমান, সুগ্রীব বা জাম্বুমানের থেকে বয়সে ছিল অনেক ছোট ছিল নল ও নীল। সীতা উদ্ধারে বেরিয়ে সাগরতীরে এসে বিশাল সাগর পেরোনো রাম লক্ষ্মণের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তখনই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন সুগ্রীব হনুমানরা। কিন্তু উত্তাল সমুদ্রে সেতু তৈরি হবে কী করে? তারা যত পাথরই জলে সাজায়, সব পাথর সাগরের জলে ডুবে যায়। তাহলে কী হবে?

নল ও নীল দুজনেই কারিগরী বিদ্যায় পটু। কিষ্কিন্ধ্যার যাবতীয় ঘর-বাড়ির কারিগর ছিল নল, রাম তখন নলের কাছে পৌঁছলেন। রাম সাহায্য চাইলেন। নল বলল সে পারে কিন্তু দলের সকলেই তাদের চেয়ে বড়। হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, জাম্বুবান, এদের মধ্য থেকে সেতু বানাতে এগিয়ে এলে অহংকারের পরিচয় দেওয়া হত। তাই সে রামের অনুরোধের অপেক্ষা করছিল। নিজের পরিচয়ও দেয় তারা, দেবতা বিশ্বকর্মার ছেলে তারা, জহ্নুমুনির কাছে বড় হয়েছে। কারিগরী শিখেছে স্বয়ং ব্রহ্মা কাছে, এ সব কৌশল তার জানা।

এতে হনুমানের কিঞ্চিৎ ইগোতে লেগেছিল, সে সাহায্যর অছিলায় হিংসায় বড় বড় পাথর এনে নলের উপর ফেলতে লাগল। তবে রাম অবশ্য পড়ে হনুমান ও নলের বিবাদ মিটিয়েছিল। ভাসিয়ে রাখার অভিশাপ ছিল নল নীলের শক্তি। সীতা উদ্ধারে বানর সেনাদের লঙ্কা যাওয়ার জন্য সমুদ্রের ওপর সেতু নির্মাণ করল নল ও নীল। দক্ষিণ ভারতের রামেশ্বরম থেকে শ্রীলঙ্কার মান্নার পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পক ছিল বানর নল ও নলের ভ্রাতা নীল। এটিই রাম সেতু নামে পরিচিত। নলকে বানরদের স্থপতি বা স্থাপত্যশিল্পী হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বানরকূলে নল ও নীল বানরেরা ছিল স্থাপত্যবিদ।

নল ও নীলের বানানো ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝের রাম সেতু দীর্ঘদিন নাকি অক্ষত ছিল। যদিও পরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। নল আর নীল রাম-রাবণের যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রয়েছে নীল রাবণের মাথার ওপর উঠে প্রস্রাব করে রাবণকে অশুচি করে তার যজ্ঞ পণ্ড করেছিল। রামায়ণে রাম রাবণের যুদ্ধে নল ও নীল মারা যান রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদের হাতে। অন্যদিকে, জৈন গ্রন্থ অনুসারে নল জৈনধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং মাঙ্গী-তুঙ্গীর নিকট মোক্ষলাভ করেন। আবার মহাভারতেও নাকি তারা রাক্ষস দমন করেছিল। যুগে যুগে কালের নিয়মে বদলে গিয়েছে নল ও নীলের কাহিনী। বহু জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু রামকে যে নল ও নীল সাহায্য করেছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠের মত তেমনই বলে।

নল আর নীল বানর হলেও বাংলায় তারা মানুষরূপেই পুজো পেতে লাগল। বিশ্বকর্মার মূর্তির দুই পাশে দুই পুত্র নল আর নীল ক্রমেই বাংলার লোকাচারে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু কালের নিয়মে তারা আজ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...