'পথের পাঁচালি' তে গ্রামের পথে পথে ঘোরার পর সত্যজিৎ রায় এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন- 'এখন আমি আর অনেক কিছুই জানি। আমি এর মাটিকে জানি, জানি এর ঋতুগুলিকে। এর গাছপালা অরণ্য ফুল এসবও জানি। আমি এখন জানি মাঠে কেমন করে পুরুষেরা কাজ করে, মেয়েরা কিভাবে কুয়োতলায় গল্প করে। জানি রোদবৃষ্টিতে যে শিশুরা খেলা করে সারা পৃথিবীর যে কোন শিশুর মতোই তাদের আচরণ।' নাগরিক সভ্যতায় বড়ো হতে হতে ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ রেনোয়ারের 'দ্যা রিভার' ছবির লোকেশন খুঁজতে খুঁজতে তাঁর গ্রামের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। তাই তাঁর দৃশ্যপটে বারবার উঠে এসেছে বাংলার চেনা অচেনা গ্রামের ছবি।
'পথের পাঁচালি'র শুটিং প্রায় পুরোটাই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বোড়াল গ্রামে। শুধু বর্ধমানের কাছে পালসিটে অপু দুর্গার কাশফুল দেখার দৃশ্য তোলা হয়েছিল। 'অপুর সংসার' এর শুটিং হয় জলঙ্গি নদীর ধারে মহেশগঞ্জ গ্রামে। শান্তিনিকেতন তাঁর খুব প্রিয় জায়গা, তাই বারবার তিনি শান্তির নীড়ে গেছেন তার মনের মতো দৃশ্যপট খুঁজে পাবার আশায়। 'অশনি সংকেত' হয়ে 'আগন্তুক' খুঁজে পেয়েছেন সেখানকার গ্রামে। বীরভূমের বিভিন্ন গ্রামে তিনি শুটিংয়ের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। রামপুরহাট থেকে কিছুটা দূরেই নতুনগ্রাম হয়েছিল 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' সিনেমায় গুপীর গ্রাম। নতুন গ্রামের এক নদীর ধারে গুপী বাঘার প্রথম ভোজ, ডুলিতে যাবার দৃশ্য, 'ঝুণ্ডি' বলে প্রথম হাততালি সহ অনেক দৃশ্য শ্যুট করা হয়। 'অভিযান' সিনেমার দৃশ্য গ্রহণের জন্য গিয়েছেন দুবরাজপুর ও সেখানের মামা ভাগ্নে পাহাড়ে। কত অখ্যাত জায়গা তার চোখে সুন্দর হয়ে উঠেছে, ও নিজের ক্যামেরার চোখ দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন। তিনি গ্রামকে দেখেছেন খুব নিবিড় ভাবে, অন্তরঙ্গ ভাবে মিশেছেন গ্রামের প্রকৃতির সঙ্গে, সেখানের জনপদের সঙ্গে। যে সব জায়গা এক সময় ছিল অজানা অচেনা, জনমানসে ছিল অখ্যাত, সেসব জায়গাও বিখ্যাত হয়ে গেছে সত্যজিতের ক্যামেরায়। আসলে দেখা আর দেখার চোখ এই দুটোর মধ্যে আকাশ জমিন ফারাক। তিনি বাংলার কত কত গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর খুঁজে পেয়েছেন অরূপ রতন। সেই সব প্রকৃতির প্রকৃত ব্যবহার তার সিনেমা কে অন্য রকম মাত্রা দিয়েছে। পুরুলিয়ার জয়চন্ডী পাহাড়ের আশেপাশের গ্রামে গেছেন, সেখানে গিয়ে 'হীরক রাজার দেশে' এর শুটিং করেছেন। উদয়ন পন্ডিতের আত্মগোপনের জায়গা ছিল এখানে। সত্যজিতের 'জলসাগর' দেখার পরেই মুর্শিদাবাদের নিমতিতা গ্রাম ও সেখানকার রাজবাড়ী মানুষের চোখে সুন্দর হয়ে উঠলো। শুধু চলচিত্র কেন তার লেখাতেও গ্রামের দৃশ্য, গ্রাম্য চরিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। নব রূপে আবিষ্কৃত গ্রাম বাংলার ছোট ছোট চিত্রকেই তিনি চলচ্চিত্রে নতুন আঙ্গিকে রূপদান করেছেন। তিনি তার গল্পের সফল চরিত্রদের কে গ্রামের আঙিনায় এনে শৈশব চিনিয়েছেন।
বছর দশেক বয়সে একবার তিনি তার মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়ে কিছুদিন থাকেন। সেই সময় একদিন সকালে উত্তরায়ন গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। ছোট্ট সত্যজিৎ তার অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিয়েছেন ঠাকুরের দিকে। সেই সময় ঠাকুর তার খাতায় সই এর সঙ্গে একটি আট লাইনের বিখ্যাত কবিতা লিখে দিয়েছিলেন- "বহুদিন ধরে বহুক্রোশ দূরে...একটি শিশির বিন্দু"। সুপ্রভা দাস'কে বলেছিলেন- 'এটার মানে ও আর একটু বড় হলে বুঝবে'। সত্যি সত্যি সত্যজিৎ বুঝেছিলেন রবি কবির কথা, আর সেই সত্যকে তিনি ছবির পর্দায় নিয়ে এসেছেন। করে তুলেছেন আকর্ষণীয়। রবি ঠাকুরের 'দেখা হয় নাই একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু'র মধ্য তিনি বাঙালিদের সিন্ধু দর্শন করিয়েছেন। রবি কবির আক্ষেপ তিনি ছবির পরতে অপূর্ব ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কতখানি ভালোবাসা ও দেখার চোখ থাকলে এরকম সাধারণের মধ্যে অসাধারন আকর খুঁজে পাওয়া সম্ভব!
সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন একটি পোস্ট দেখা যায়- “সত্যজিৎ রায়কে শুটিং করতে বিদেশ যেতে হয়নি, কেবল পুরস্কারগুলো নিতে বিদেশ যেতে হত”। সত্যি তো তাই! অস্কার জয়ী এই পরিচালক বিদেশে শুটিং করতে যাননি তিনি গ্রামের আঙিনায় বিদেশের রঙীন দৃশ্যকে চিত্রায়িত করেছেন অবলীলায়। ঠিক যেভাবে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় তার উপন্যাসে গ্রামের প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সেরকমই এক চোখ দিয়ে সত্যজিৎ দেখেছেন গ্রামকে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা গল্প থেকেই ছবি পরিচালনা করে তিনি ১১ টি পুরস্কার পান। তাই গ্রামের বিভূতিই তাঁর ছবির ভূষণ, সেই সাদামাটা গ্রাম্যতার উপরেই তিনি সোনা ফলিয়েছেন। 'পথের পাঁচালী'র সেই নিশ্চিন্তিপুর গ্রাম তাকে নিশ্চিন্তে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে সেখান থেকে রসদ নিয়ে গল্পের বুনোট কিভাবে বাঁধতে হয়। আর সেই গল্প কে কিভাবে ছড়িয়ে দিতে হয় দর্শকদের ভালোলাগায়। এই ভালোলাগায় তো তাকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলেছে। তাই তার চোখে গ্রাম শুধু চোখের আরাম নয় মনের শান্তি, তৃপ্তির অবগাহন। তিনি গ্রামের মধ্যেই খুঁজে পেতেন গল্পের আখর। চোখ ধাঁধানো ঝকমকানি নয় বরং সত্যিকারের দেখার চোখ তাকে অন্যদের থেকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে। শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির এই বিশালতার জন্যেই তো তিনি সকলের কাছে মনের মানিক।