উনিশ শতক সবে শুরু হয়েছে। দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে। বিদেশি পণ্য বয়কট চলছেই। সেই সময়েই শিল্পে স্বাধীন হতে হবে দেশকে এই ভাবনা থেকেই একটি প্রতিষ্ঠান শুরুর স্বপ্ন দেখলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
সালটা ১৯০১। হাতে মূলধন বলতে মাত্র আটশো টাকা। আর তুখোড় আত্মবিশ্বাস। এই নিয়েই পথ চলার শুরুয়াত।
আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে গড়ে উঠল বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কার্স লিমিটেড। ভারতের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল । ১৮৯২ সালে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই অবশ্য প্রথম সূচনা। ১৯০১ সালে তা পাবলিক লিমিটেড সংস্থায় পরিনত হয়। তার আগে পর্যন্ত এই সংস্থার নাম ছিল ' বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্ক'
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় উপমহাদেশের শিল্পায়নে বেঙ্গল কেমিক্যাল এক গুরুত্বপূর্ণ নাম।
শুরু থেকেই গবেষণা এবং পণ্যের ক্ষেত্রে নিজেকে আলাদা ভাবে চেনাতে সচেষ্ট হয় এই সংস্থা। প্রতিটি বিষয়ে প্রফুল্ল চন্দ্রের অমানুষিক শ্রম ঘামের দাগ লেগে।
১৯০৩ সালে তিনি পেলেন রাজশেখর বসুকে। প্রফুল্ল চন্দ্রের সঙ্গে রাজশেখর বসুর সাক্ষাৎ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল রাজশেখরের জীবনের। তিনি এই সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন ' কেমিস্ট' হিসেবে। পরবর্তী সময়ে ম্যানেজারের দায়িত্বে আসেন। বেঙ্গল কেমিক্যাল তাঁর জীবন জুড়ে ছিল। প্রফুল্ল চন্দ্র বেঙ্গল কেমিক্যালের জন্ম দিয়েছিলেন। আর সন্তান স্নেহে তাকে বড় করেছিলেন পরশুরাম।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। টেকনিক্যাল এডভাইসার হিসেবে। কর্মচারীদের সঙ্গে মিশতেন একেবারে পরিবারের মতো। পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল কেমিক্যালে যে সমস্ত জিনিস তৈরি হত, রাজশেখর নিজে তার নাম দিতেন। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত মিলিয়ে নাম। সেভাবেই, 'কোয়াটিন', 'আইওডিন', 'বোরোলেপ' নানারকম নসম এসেছে।
শুধু ওষুধ বা রাসায়নিক নয়, প্রসাধনও ছিল। বেঙ্গল কেমিক্যালের বিজ্ঞাপন বের হত পত্রিকার পাতায়। সেই বিজ্ঞাপনের বয়ান লিখতেন রাজশেখর নিজে। বেঙ্গল কেমিক্যালে রসায়নের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল দেশপ্রেম, স্বদেশিয়ানা আর সাহিত্য।
১৯৭৭ সালে সংস্থার জাতীয়করণ। পরবর্তী দশকগুলোতে নানারকম ঝড় ঝাপটা। বহুবার বাতি কেঁপে উঠেছে ঝড়ে। কিন্তু হাল ছাড়েননি সংস্থার কর্মীরা। তাঁদের লড়াইতে আজও বেঁচে আছে এই ঐতিহ্য বাহী সংস্থা। পাঁচ দশক পর ২০১৬-১৭ তে টানা মুনাফা করে গিয়েছে। ২০২০ তে গোটা বিশ্ব যখন করোনার দাপটে ওলটপালট তখন আবার স্ব মহিমায় ফিরে এল বেঙ্গল কেমিক্যাল। করোনা রোগীদের জন্য হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করবে সংস্থা। ইতিমধ্যেই পেয়েছে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র।