১৯৪৭ সাল ১৫ আগস্ট, বাংলার বুক চিড়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্ম। দু-টুকরো হল বাংলা, দেশভাগপীড়িত জাতির পিঠে বসে গেল কাঁটাতারের দাগ। শরণার্থী, উদ্বাস্তু ট্যাগ জুটে গেল বাঙালির। এই বাংলার বাঙালিরাই কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার জন্যে লড়ে গিয়েছিলেন। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে লিখেছিলেন স্বাধীনতার ইতিহাস। এই বাংলার মাটি থেকে প্রথম দেশের স্বাধীনতার ডাক উঠেছিল। এই মাটি ক্ষুদিরাম, সুভাষ, যতীন দাসদের মাটি, ভাবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, বেলা মিত্র, প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনীর রক্ত ঘাম মিশে আছে এখানে। বিনয়-বদল-দীনেশ, মাস্টারদার স্বাধীন ভারত দেখার স্বপ্ন মিশেছে এই বাংলার আকাশে। সিরাজ থেকে সুভাষ এই বাংলাই লড়েছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে।
মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকা থেকে এলেন মাকসুদাবাদে, সুবে বাংলার বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী হল মুর্শিদাবাদ। কালক্রমে নবাব হলেন সিরাজউদ্দৌলার। ততদিনে বেনিয়ারা ঢুকে পড়েছে বাংলায়। গোটা ভারতের জাঁকিয়ে বসেছে লালমুখো সাহেবের দল। আস্তে আস্তে শাসক হয়ে উঠতে চাইল তারা। টের পেলেন সিরাজ, মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে অস্ত্র ধরলেন। কিন্তু ঈর্ষা আর ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন। ১৬৫০-১৬৬০-এ ভারতে ঢোকা বেনিয়ারা এদ্দিনে পাকা করলেন নিজেদের পায়ের তলার জমি। পলাশির আমবাগানে অস্ত গেল দেশের স্বাধীনতা। শুরু পরাধীনতার যুগ, দ্বৈতশাসন কায়েম হল। ইংরেজরাই হয়ে উঠল শাসক। কিন্তু বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়? না কেউ কোনদিন বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পেরেছে? শুরু হল লড়াই। শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই, সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ। ১৭৭০-এর দশক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠল বাংলা। দেবী চৌধুরীরানী, ভবানী পাঠক, রঙ্গরাজদের কথা উপন্যাসে বুনেছিলেন বঙ্কিম। কাজ হয়নি, শাসককে দমিয়ে রাখা যায়। ১৮৫৫ সালে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করলেন, সিধু কানুর লড়াই আজও অমর। বীরসা মুন্ডার উলুগুলান, তিতুমীরের বারাসাত বিদ্রোহও ভুলবার নয়। ১৮৫৭ এই বাংলা থেকে ঢেউ উঠল সিপাহী বিদ্রোহের। বারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে শুরু করলেন বিদ্রোহ, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এ দেশে প্রথম সংগঠিত সশস্ত্র আন্দোলন। রাজনীতি করতে শিখল ভারতীয়রা। রাজনৈতিকভাবে আন্দোলন চলছে। আর বাংলা থেকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ডাক উঠছে।
গুলি করে, বোম ছুঁড়ে সাহেব মারতে শুরু করলেন বাংলার ছেলে-মেয়েরা। ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি পড়লেন, বিনয় বাদল দীনেশরা রাইটার্স অভিযান করলেন, ওদিকে জালালবাদ পাহাড়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, ভয় পেলে গেল ব্রিটিশরা। বুদ্ধি, মেধাশক্তি, দেহের বল সবেতেই এগিয়ে বাংলা। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিবদাস ভাদুড়ীরা খালি পায়েই হারিয়ে দিল সাহেবদের। বাংলার অলিগলিতে তৈরি হল গুপ্ত সমিতি, অনুশীলন, যুগান্তর দল। কাগজ, পত্রিকা ছেপে বাঙালি ভারত জুড়ে ছড়িয়েদিল লড়াইয়ের ডাক। পরাধীন দেশে আগুন হয়ে উঠল বাংলা। ভীত ব্রিটিশ রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে, সাহেবের দল বুঝেছিল বাংলা থেকেই ডাক উঠবে স্বরাজের। তবে রাজধানী সরানোর আগে, বাংলা ভাগ করেই বাংলাকে দুর্বল করতে চেয়েছিল ব্রিটিশ। ১৯০৫-এর কার্জনের বঙ্গভঙ্গের চক্রান্ত সফল হয়নি। বাঙালি রুখে দিয়েছিল বাংলা ভাগ, কিন্তু ১৯১১ তে রাজধানী সরলই। এরপর লড়াই চলছিল, আত্ম বলিদান দিচ্ছিলেন বাঙালিরা। লড়াইয়ের তেজ বাড়ছিল কিন্তু একটা স্ফুলিঙ্গের অভাব ছিল। সেটাই হয়ে উঠলেন সুভাষ বোস। সেটাই ভারতের স্বাধীনতার শেষ লড়াই বলা চলে। আজাদ হিন্দ ফৌজের মার্চে কেঁপে উঠেছিল বাংলা। কিন্তু শেষ দেখে যেতে পারেননি সুভাষ। প্রমাণিত ইতিহাস বলে স্বাধীন ভারত তাঁর দেখা হয়। পরাজিত নায়ক হিসেবেই তাঁর ইতিহাস লেখা হবে। কিন্তু ইংরেজরা স্বীকার করেছিল সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াইয়ের কারণেই তারা উপলব্ধি করেছিল ভারতে আর তাদের খবরদারি চলবে না। ভারতীয়দের হাতে স্বাধীনতা দেওয়াই একমাত্র উপায়। অবশেষ স্বাধীন হল দেশ কিন্তু সুচতুর ব্রিটিশ বাংলা তথা দেশকে দুভাগ ভেঙে দিয়ে গেল। সারা জীবনের শত্রুতা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের জন্ম হল।
দেশভাগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল বাংলা। আজও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বলে, সবচেয়ে বেশি বলিদান বাঙালিরাই দিয়েছে। আন্দামানে সেলুলার জেলে কালাপানি খেটেছে, ফাঁসির দড়ি পরেছে, বুকে গুলি নিয়েছে। কিন্তু মশাল নিভতে দেয়নি। যে মশাল বাংলা জ্বেলেছিল, সেই মশালে ভর করেই স্বাধীনতা এসেছে। হাঁটতে শিখছে ভারত, আজও হাঁটতে হাঁটতে ৭৫ বছর পেরিয়ে এল আমাদের দেশ। গর্বের ভারত।