কালী হলেন শক্তির আধার। রক্তবসনা রক্তমাল্যধারিণী কালরাত্রিরূপা কালী হলেন রক্তপিপাসু এক দেবী। যার আরাধনা হয় গোটা জগৎ জুড়ে। বিবেকানন্দের নাচুক তাহাতে শ্যামা কবিতায় রয়েছে, চূর্ণ হোক স্বার্থ, সাধ, মান হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা। শ্যামা মিলিয়েছেন শাক্ত, শৈব আর বৈষ্ণবকে। কালীর কথা বললেই নদীয়ার নাম এসে পড়ে কারণ, আজকের বাংলায় কালীর যে রূপ প্রচলিত, তা দান করেছিলেন আগমবাগীশ। আবার সে জেলা বৈষ্ণবদের পুণ্যভূমি।
আজ কালী কথায় বেলপুকুরের কথা বলব। গ্রামটি কালীক্ষেত্র, তান্ত্রিক গ্রাম, ধুবুলিয়া রেল স্টেশনের একটু দূরে নদিয়া জেলার এক প্রাচীন গ্রাম এটি। কথায় বলে, বেলপুকুর বারাণসীর সমতুল্য। গ্রামের প্রাচীন পণ্ডিত বলরাম তর্কপঞ্চাননের লেখা সত্যপীরের পাঁচালীতে গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়, গ্রামে এক সময় প্রচুর বেলগাছ ছিল, ছিল অনেক পুকুর, তাই গ্রামের নাম হয়েছে বেলপুকুর। প্রথমে অবশ্য গ্রামের নাম ছিল বিল্বপুষ্করিণী। তা থেকে হয় বেলপুখুরিয়া, সেটি আবার লোকমুখে বদলে হয়ে বেলপুকুর। একদা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত গঙ্গা। বিল্বেশ্বর আর পক্ষেশ্বর নামে দুই শিবের মন্দিরও। সেই থেকে গ্রামের নাম হয়েছিল বিল্বপক্ষেশ্বর। অপভ্রংশ হয়ে নাম হয় বেলপুকুর।
গ্রামের গঙ্গার খাতে বইছে খাল, স্থানীয়দের মুখে নাম গুড়গুড়ে খাল। বেলপুকুর গ্রামের কাছে এই গুড়গুড়ে খালের একাংশের নাম মালসাদহ। অপর অংশের নাম চিলতেদহ। গরমকালে শুষ্ক চিলতে দহতে, মালসা দহ থেকে জল আসে। গ্রামের লোকে বলে মালসা দহের জল কখনও ফুরোয় না। মানুষের বিশ্বাস, এখানে স্বয়ং শিবঠাকুর আর তাঁর সোনার ষাঁড় অধিষ্ঠান করছে। ষাঁড় নাকি গ্রামকে পাহারা দেয়। মালসা দহে শিব থাকলেও, এখানে শিব পূজিত হন না, এখানে গঙ্গার আরাধনা হয়। এই গ্রামেই রয়েছে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মামার বাড়ি। শচীদেবী এই গ্রামেরই মেয়ে। চৈতন্যদেবের দাদামশাই শ্রীনীলাম্বর চক্রবর্তী শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপ হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এই গ্রামে আসেন। বেলপুকুর গ্রামে গেলে নীলাম্বর চক্রবর্তীর আদি ভিটে দেখা যায়। সেখানে রয়েছে একটা ছোট্ট টিনের চালের মন্দির। নীলাম্বর চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত মদনগোপাল জিউ এখানে নিত্য পূজিত হন। লোক বিশ্বাস মতে, সতেরোশো বছরের পুরনো এই বিগ্রহটি নাকি স্বয়ং বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেছিলেন। ভাবা যায় তন্ত্রের পীঠস্থান হয়ে উঠছে বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান। আজ এই গ্রামে প্রায় দুশোটির মতো কালীপুজো হয়। এখানকার মানুষের বিশ্বাস আজও প্রতি কালীপুজোর রাতে সিদ্ধপুরুষ রামচন্দ্র ঠাকুরের মহাশঙ্খের মালা জেগে।
আবার কেউ কেউ বলেন, বেলপুকুর গ্রাম নাকি অনেক কাল আগেই গঙ্গার গর্ভে চলে গিয়েছে। বর্তমানে যে গ্রামটি বেলপুকুর নামে পরিচিত, সেটা আদপে মেঘা ডাকাতের আস্তানা। যার নাম ছিল মেঘার চর। সেই মেঘার চরই আজ বেলপুকুর। তবে পুরোটাই জনশ্রুতি। গ্রামে দীপান্বিতা অমাবস্যা রাতে নাকি গ্রামবাসীদের সঙ্গে অলৌকিক মহাশঙ্খের মালাও জেগে থাকে। এটাই গ্রামের প্রচলিত কিংবদন্তি।
ষোড়শ শতকের শেষের দিকের ঘটনা। মোঘল আমল, বেলপুখুরিয়া গ্রামে নদিয়ার রাজা রুদ্র রায় মহাশক্তিশালী এক কালীসাধকের সন্ধান পেলেন। মহারাজা জনা পঁচিশেক বন্ধুবান্ধব, পাইক নিয়ে বজরায় চড়ে গ্রামে এলেন। দেখলেন এক জন সাধক বেলগাছ দিয়ে ঘেরা একটি জলাশয়ের ধারে সাধনা করছেন। মহারাজ এসেছেন দেখে সেই সাধক মহারাজসহ পঁচিশ জনের খাওয়ার বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু সেই সাধকের থাকার জায়গা ছিল না। রাজা রুদ্র রায় অবাক হলেন। কথাপ্রসঙ্গে সাধক রাজাকে জানলেন, সাধকের উপর গৃহী হওয়ার আদেশ আছে। রাজা সাধকদের গঙ্গার ধারে পাঁচশো বিঘা জমি দান করলেন। এই সাধক রামচন্দ্র ঠাকুর।
আরেক কিংবদন্তি মতে, ষোড়শ শতকে ওপার বাংলায় মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে রামভদ্রপুর গ্রামে জনৈক গোঁসাই ভট্টাচার্য নামে এক বড় সাধক বাস করতেন। জনশ্রুতি রয়েছে, একান্নটি করোটি নির্মিত মহাশঙ্খের মালা ছিল তার। তার মেয়ে লীলাবতী, জামাইয়ের নাম যদুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। যদুনাথের বাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গের কনকসার গ্রামে। এদেরই পুত্র রামচন্দ্র ঠাকুর। বাবার মৃত্যুর পর সে জলপথে নবদ্বীপ চলে আসে। শঙ্কর তর্কবাগীশের কাছে শাস্ত্র পাঠ শেষ করে মহাশঙ্খের মালা নিয়ে তিনি গেলেন তারাপীঠে। সেখানে সাধনা শেষ করে তিনি এলেন বেলপুকুর গ্রামে, তখনই রাজা রুদ্র রায়ের সঙ্গে তার দেখা হয়।
এরপর রামচন্দ্র ঠাকুর নিজের জন্মভিটে রামভদ্রপুরে গিয়ে বিয়ে করেন। বোনদের বিয়ে দেন। ভাইদের নিজের সম্পত্তি দান করেন।নিজের গ্রাম থেকে এক ঘর তাঁতি, নাপিত, ধোপা, ভূঁইমালী শ্রেণির লোকদের নিয়ে তিনি উঠে আসেন রাজার দান করা বেলপুকুর গ্রামের জমিতে। গ্রামের মাঝামাঝি ব্রাহ্মণ পাড়া স্থাপন করেন। তারপর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ দিয়ে গ্রামটিকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছিলেন।
রামচন্দ্র ঠাকুর নয় পুত্রের জনক ছিলেন। তার দ্বিতীয় পুত্র রামগোবিন্দ ন্যায়ালঙ্কার এবং তৃতীয় পুত্র রত্নেশ্বর ন্যায়বাগীশ বেলপুকুর গ্রামে থেকে। বাকিরা ঢাকার ফরিদপুরে চলে যান। রামচন্দ্র ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র যে পাড়ায় থাকতেন, সেই পাড়ার নাম হল বিদ্যালঙ্কার পাড়া। রামঠাকুরের তৃতীয় পুত্র রত্নেশ্বর ন্যায়বাগীশের বংশধর রঘুরাম বিদ্যাবাচস্পতির নাম অনুযায়ী গ্রামের একটি পাড়ার নাম হয়েছিল বাচস্পতিপাড়া। সাধক রামচন্দ্রের পরিবারের উত্তরসূরিদের বাড়িগুলোর কালীপুজো এই গ্রামের আকর্ষণ। রঘুরামের চার পুত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন নিঃসন্তান। বাকি তিন পুত্র কালীশঙ্কর, গোপীকান্ত ও রুক্মিণীকান্ত, তাদের বাড়ি যথাক্রমে বড় বাড়ি, নবাড়ি ও ছোট বাড়ি নামে পরিচিত হয়েছিল। এই তিন বাড়ির কালীপুজোই বেশ বিখ্যাত। মহাশঙ্খের মালা রয়েছে নবাড়িতে। কালীপুজোর দিন গভীর রাতে মালা সকলের সামনে আসে। মালা নিয়ে নানা কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে। বলা হয়, বছরে একমাত্র কালী পুজোর রাতে এই মালা প্রাণ পায়। সেই রাতে মালা নাকি কারণবারি পান করে। নবাড়িতে কালীপুজোর গভীর রাতে এই মালার বিশেষ পুজো হয়।
কথিত আছে, বেলপুকুর গ্রামে সাতটি টোল ছিল। প্রথম টোলটি ছিল মাঝেরপাড়ায়, যা সিদ্ধান্ত পাড়া নামে খ্যাত। টোলটি চালাতেন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত প্রসন্নকুমার ন্যায়রত্ন। এঁর কাছে বিধবা বিবাহ সম্পর্কে মতামত নেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর এসেছিলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় টোলটি ছিল চূড়ামণি পাড়ায়। দ্বিতীয় টোল চালাতেন শ্রীক্ষেত্র চূড়ামণি। চতুর্থ ও পঞ্চম টোল ছিল বাচস্পতি পাড়ায়। আর ষষ্ঠ টোলটি ছিল বিদ্যালঙ্কার পাড়ায়। এই টোলটি চালাতেন দেবীপ্রসন্ন স্মৃতিরত্ন। আর সপ্তম টোলটি ছিল বিদ্যালঙ্কার পাড়ায়। টোলটির নাম দেবীপ্রসন্ন চতুষ্পাঠী। এই টোলটির ভগ্নাবশেষ এখনও বেলপুকুর গ্রামে রয়েছে। যা টোলবাড়ি নামে পরিচিত। এই টোলবাড়ির অমৃতহরি স্মৃতিতীর্থ মা কালীর পুজো করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। প্রতি অমাবস্যায় মূর্তি গড়ে আজও টোলবাড়িতে পুজো হয়। পরিবারের উপাধি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের ভট্টাচার্য উপাধি দিয়েছিলেন। শোনা যায়, এই পরিবারের এক সিদ্ধপুরুষ অমাবস্যার রাতে রাজাকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন। তখন রাজা খুশি হয়ে তাঁকে ভট্টাচার্য উপাধি দেন। টোলবাড়িতেই নিত্যেশ্বর মহাদেবের নিত্য পুজো হয়। দেবীপ্রসন্নের ছেলে নিত্যহরিকে শিবঠাকুর স্বপ্নাদেশ দেন, তিনি কাশীধামে মাটির তলায় এক জায়গায় রয়েছেন। সেখান থেকে তাকে যেন উদ্ধার করা হয়। নিত্যহরি সেই শিবকে কাশীধামের মাটি থেকে তুলে মাথায় করে বেলপুকুর গ্রামে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন। নিত্যহরির আনা শিব নিত্যেশ্বর নাম নিয়ে পূজিত হন।
বেলপুকুর গ্রামের সিদ্ধেশ্বরী তলার কালীপুজো হয় কালীপুজোর দিন দিনের বেলায়। মাতৃপূজার বেদি পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। গ্রামে প্রথমে এই পুজোটিই করা হয়। এর পর সন্ধে থেকে গ্রামের অন্যান্য পুজো শুরু হয়। বড় বাড়ি, নবাড়ি ও ছোট বাড়ির পুজো হয় গভীর রাতে। বেলপুকুর ও তার আশপাশের গ্রামের কালীরা বোন হিসেবে থাকে। যেমন সর্দারপাড়ার কালী বড় বোন, সিদ্ধেশ্বরী বারোয়ারি তলায় কালী মেজ বোন। দুই কালীর উচ্চতা হয় কুড়ি হাত। গাবতলার কালী আবার নবোন, নাথ বাড়ির কালী হলেন ছোট বোন। কালী নিয়ে নানান কিংবদন্তি নিয়ে বেঁচে রয়েছে এই গ্রাম।
ছবিঃ প্রতীকী