এক নারী। আর দুই উন্মত্ত প্রেমিক। রাগ-লোভ-হিংসা আর পরিণামে মৃত্যু।
না, কোনও সিনেমার গল্প নয়, বরং ইতিহাস থেকে উঠে আসা ‘সত্যি’ গল্পের কাহিনি। এভাবেই জন্ম হয়েছিল ‘বাকরখানি’র। বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যশালী খাবারগুলোর অন্যতম।
বাংলা দেশের পুরনো ঢাকার জনপ্রিয় খাবার বাকরখানি। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ বঙ্গেও সমান জনপ্রিয়। কুয়েত, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। মশলাদার রুটি বাকরখানি।
বাকরখানির জন্ম নিয়ে জন প্রিয় এক কাহিনী প্রচলিত আছে। প্রেমের কাহিনীর রস যেন বাড়তি স্বাদ জুগিয়েছে।
কাহিনী অনুযায়ী, সতেরো, অন্যমতে আঠারো শতকে তুর্কিস্তান থেকে আগা বাকের নামে এক ভাগ্যবিড়ম্বিত বালক ক্রীতদাস হয়ে এসেছিল এ দেশে। বাংলায় তখন সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ। সুদর্শন বালকটিকে কিনে নিয়েছিলেন।
আগা বাকেরের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে নবাব তাকে লেখাপড়া ও সামরিক বিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তোলেন। যৌবনে পা দিতেই আগা বাকেরকে প্রথমে চট্টগ্রামে ফৌজদারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় তিনি বাকলা চন্দ্রদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন। তার নামানুসারে বাকেরগঞ্জ। (পরবর্তীকালের বরিশাল) জেলার উৎপত্তি হয়।
আগা বাকের ভালোবেসেছিলেন সুন্দরী নর্তকী খনি বেগমকে।
কিন্তু সেই ভালোবাসা নিষ্কন্টক ছিল না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজির জাহান্দার খাঁর ছেলে কোতোয়াল জয়নুল খাঁ। এই নর্তকীকে ঘিরে আগা বাকের ও জয়নুল খাঁর দ্বন্দ্ব-সংঘাত নাটকীয় মোড় নিতে থাকে।
সুবেদার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ বাকেরকে ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন। বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এসেছিলেন আগা বাকের।
এই কাহিনী এখানেই শেষ হয় না, খনি বেগমকে হরণ করে দুর্গম চন্দ্রদ্বীপে পালিয়ে গিয়েছিলেন জয়নুল খাঁ।
প্রেমিকাকে উদ্ধারে রণসাজে চন্দ্রদ্বীপে উপস্থিত হন আগা বাকের।
বাকেরের হাত এড়ানো সম্ভব নয় দেখে, জয়নুল খাঁ খনি বেগমকে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হন।
খনি বেগমকে না পেলেও প্রেমের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘বাকের খনি’।
সাধারণ মানুষের উচ্চারণে যা ক্রমে ‘বাকরখানি’ হয়ে গেছে।
পুরনো ঢাকায় হাজারো পরিবার আছে যারা বংশ পরম্পরায় বাকরখানির কারিগর।
তবে বাকরখানি’র জন্ম নিয়ে এরকম প্রেমের কাহিনি অনেকেই মানতে নারাজ।
গবেষকদের মতে বাকরখানি রুটির জন্ম হয়েছিল মউঘল হেঁশেলে। নবাব, আমির- ওমরাহদের প্রিয় ছিল।
বাকরখানি তৈরি হতো মালাই-মাখন দিয়ে । এখন অবশ্য সেই দিন আর নেই। ময়দায় সাদা তেল ডালডা ব্যবহার করা হয়। বাকরখানি পরিবেশন করা হয় কোর্মা-কাবাব-এর সঙ্গে। কোথাও কোথাও আবার ক্ষীর-মালাই দিয়ে।