কালীকথা: বেহালার মা সিদ্ধেশ্বরী

আজ কলকাতায় প্রচীন এক কালীমন্দিরের কথা। তবে তার আগে খানিক ইতিহাস চর্চা। আমরা বেহালা নিয়ে কথা বলব। বাঙালির আইকন সৌরভ গাঙ্গুলির বাড়ি আজকের বেহালাকে আপামোর বাঙালির কাছে বিখ্যাত করে তুলেছে। কিন্তু এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। আজকের বেহালা বৃহত্তর কলকাতার অন্তর্গত হলেও, এই জনপদ প্রাচীনত্বে কলকাতার দাদা। কলিকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর নিয়ে তখনও আমাদের কলকাতা গড়ে ওঠেনি, তখন থেকেই বেহালা অঞ্চল ছিল এক সমৃদ্ধ জনপদ। এই অঞ্চলের একটি বিখ্যাত কালীমন্দির হল সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। যা আমাদের আজকের আলোচ্য। এই মন্দির যেখানে অবস্থিত, মধ্যযুগে সেই এলাকার নাম ছিল বড়শে বহুলা। কথিত রয়েছে, মাছ ধরার বড়শি থেকেই এই নামের উত্‍পত্তি। পরবর্তীকালে, মুখে মুখে সেই নাম বদলে গিয়ে, হয়ে গেল বড়িশা। 
 
বেহালা অঞ্চলের জমিদার পরিবার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা হল কলকাতার অন্যতম বনেদি পরিবার। এদের আটচালা থেকেই কলকাতার জন্ম। এই পরিবারই কালীঘাট মন্দিরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার বেহালার বড়িশা এলাকার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন। এটি বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম পারিবারিক দুর্গাপূজা। বেহালা নামের উৎপত্তি নিয়ে নানান কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে, যেমন প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান নারী চরিত্র বেহুলার নাম থেকেই বেহালার সৃষ্টি। আবার কেউ কেউ বলেন বহুলাপুর থেকে বেহালা নামের জন্ম হয়েছে। হিন্দু দেবী চন্ডী বা কালীর অপর নাম বহুলা, তা থেকেই বেহালা নামের উৎপত্তি। এমন অজস্র জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে বেহালা নামের নেপথ্যে। রেভারেন্ড জেমস লং, যার নামে জেমস লং সরণী সেই লং সাহেব তার লেখায় বেহালাকে ব্যালা বলে উল্লেখ করেছেন। আদপে বেহালা অঞ্চলটি ছিল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি। প্রতিটি গ্রামের নামের সঙ্গে বেহালা শব্দটি যুক্ত ছিল। যেমন - বাজারবেহালা, তামতেলবেহালা, বোঁড়শেবেহালা যা আজকের বড়িশা, সরশুনোবেহালা অর্থাৎ সরশুনো ইত্যাদি।
 
বড়িশা নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানান ইতিহাস। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭২২ সালে বাংলাকে ১৩টি চাকলা ও বহু পরগনায় ভাগ করেছিলেন। শোনা যায়, কেশবরাম রায়চৌধুরী বাংলার দক্ষিণ চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন। এই দক্ষিণ চাকলাই আজকের বড়িশা।
 
বাংলার ১১৭০ বঙ্গাব্দের ১২ জৈষ্ঠ্য ফলহারিণী কালীপুজোর দিন প্রতিষ্ঠিত হয় বেহালার সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। চতুর্ভুজা দেবী এখানে মৃন্ময়ীরূপে বিরাজমান। দেবী মাথায় রয়েছে রুপোর মুকুট, সোনার জিভ এবং গলায় রুপোর মুণ্ডমালা। দেবী মূর্তির উচ্চতা প্রায় ৫ফুট। মা সিদ্ধেশ্বরী এখানে বামাকালীরূপে বিরাজমান অর্থাৎ দেবীর বামপদ সামনে এগোনো। কালের নিয়মে প্রাচীন মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দে আবার নতুন করে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। তবে কে এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন, আর কেই বা তার সংস্কার করেছিলেন; কোনটাই নির্দিষ্ট করে আর জানা যায় না। মন্দিরের সামনের দেওয়ালে কেবল এই দুটি সালের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরট বেহালার বিদ্যাসাগর হাসপাতালের কাছে অবস্থান করছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে কালীমূর্তি ছাড়াও রয়েছে আরো চারটি দেবীমূর্তি। ষষ্ঠীদেবী, শিতলাদেবী, চন্ডীদেবী ও মনসাদেবী, এদের সঙ্গেই অবস্থান করছেন সিদ্ধেশ্বরী দেবী কালীকা।
 
নিত্যপুজোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি তিথিতে এখানে মহাসমারহে বড় করে পুজো করা হয়। বেহালা ট্রাম ডিপোর কাছে ডায়মন্ড হারবার রোডের উপরেই সিদ্ধেশ্বরী মা কালীর মন্দির অবস্থিত। এই বড়রাস্তার উপরে মন্দির অবস্থিত হওয়ার কারণ, সবসময় ভক্তদের ভিড় লেগেই থাকে।
 
২৫০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই মন্দিরে মহাড়ম্বরে দীপান্বিতা কালীপুজোর আয়োজন করা হয়। দীপান্বিতা অমাবস্যার দিন মাকে আমিষভোগ নিবেদন করা হয়। খিচুড়ি, পাঁচরকম ভাজা, লাবড়া, আলুর দম, নানা সবজির তরকারি, মাছ, মাংস, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি দেবীর ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। এছাড়াও মায়ের ভোগে থাকে রুই, কাতলা, ভেটকি, বাটামাছ ও পাঁঠার মাংস। কালীপুজোর দিন সারা রাত মন্দির খোলা থাকে। ভক্তরা মায়ের পুজো দেখেন। কালী পুজোর দিন সকাল থেকেই ভক্তেরা আসেন মায়ের পুজো দিতে। প্রতি বছর কালীপুজোর আগে মায়ের অঙ্গরাগ হয়, নবরূপে আসেন দেবী। এই মন্দিরে দীপান্বিতা কালীপুজো ছাড়াও ফলহারিণী কালীপুজো এবং রটন্তী কালীপুজোও মহা ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। বিশেষ পুজোর দিনে মায়ের নিচের ডান হাতে রাখা হয় পানপাত্র, তাতে থাকে কারণবারি। একদা এই মন্দিরে পুজোর সময় বলি হত। এখন তা বন্ধ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মায়ের আরতি হয়।
 
আজ আড়াই শতকেরও বেশি সময় ধরে​ মাথায় রুপোর মুকুট, সোনার জিভ, গলায় রুপোর মুণ্ডমালা এবং হাতে সোনার বালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেবী সিদ্ধেশ্বরী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...