প্রকৃতির ইঞ্জিনিয়ার বীভার
একটা দেশের জাতীয় প্রাণী। একটা দেশের অর্থনীতির ভিত্তি। একটা দেশের জাতীয় প্রতীক।
সি এস লিউইস এর রম্য রচনা দ্য ক্রনিকল্স্ অফ নার্নিয়া ।চার ভাইবোনের একজন কে শ্বেত পিশাচিনী আটক করেছে।বাকিরা বেরিয়েছে সন্ধানে। পৌঁছতে হবে আসলানের কাছে।কে দেখাবে পথ?
ছোট্ট শরীরেই মাহাত্ম্য হরেক। কেউ কেউ তাকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারও বলে থাকেন। অথচ নেই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি। পড়াশুনো প্রকৃতির কোলেই। জন্মগত এবং স্বভাবগত দিক থেকে সে একটা কারিগর বটে!
বাদামী রঙের, ছোট-খাট, নিশাচর এবং স্তন্যপায়ী।আকারে ইঁদুরের জাতভাই হলেও আকারে খানিক বড়।
কম বেশি সকলেই চেনেন। কাজে ও গুনে মানুষের চাইতে কম কিছু নয়। বীভার। গল্প থেকে বাস্তবে এই প্রাণীর অবাধ বিচরণ। মানুষ হোক বা খোদ মা প্রকৃতি, সাহায্যে সদা প্রস্তুত সে।দলবদ্ধতা যাদের অনন্য গুণ।শুরুতে বলা সেই দেশটার নাম কানাডা।
মানুষ এই জগতের শ্রেষ্ঠ জীব।প্রকৃতির অন্যতম সেরা সৃষ্টি। সভ্যতার ক্রমবর্ধমান ইতিহাসে চোখ বোলালে দেখা যাবে সেই মানুষই নিজের প্রয়োজনে বুক চিড়ে বদল এনেছে তার মায়ের শরীরে।
অরণ্য রোদনে গড়ে উঠেছে শহর। সমুদ্রের গতিধারা বন্ধক রেখে তৈরি হয়েছে সেতু।একইভাবে বীভারও বদল আনার গোত্রে।মানুষ ব্যতীত একমাত্র এই জাতিই এই কাজে পারদর্শী। কিন্তু সেই বদলে অপকারের চেয়ে উপকারের ভাগটা বেশী।
জলাধার গুলোতে বাঁধ নির্মাণ করে আজ এরা কারিগর। সাধারনভাবে এসব বাঁধ ১০ থেকে ১০০ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় বীভার-বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২৮০০ ফুট এবং সেটি এখনও অক্ষত রয়েছে।
গাছের গুড়ি, কাদা আর পাথর তার উপকরণ। ভাবছেন আজগুবি গল্পকথা? কীভাবে সম্ভব এসব ওইটুকু একটা চোখে না পড়ার মত আকারের প্রাণীর পক্ষে?উত্তর নিজের ধারালো দাঁত।
একটা পরিণত বীভার বছরে দুশোটির কাছাকাছি গাছ কাটতে সক্ষম। না, ওইভাবে চোখে গোল্লা পাকানোর কোনও প্রয়োজন নেই! আপনাদের বলছি, মানে পাঠকদের। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তারা গাছ কাটে না। বাসস্থান যোগাড়েই সেই পন্থা নেওয়া।
কোনও বিপদের সঙ্কেত পেলে লেজ দিয়ে জল ঝাঁপটায়। বিপদ বাড়লে জলে দুব দেয়। টানা পনেরো মিনিট দম বন্ধ করে থাকতে পারে জলের নিচে।
নিজেদের থাকার জায়গাটা হয় গম্বুজ আকৃতির।গম্বুজের চূড়ায় এদের বাস।জলের নীচ থেকে প্রবেশ করে সেখানে।অর্থাৎ তাদের নিজেদের বাসা তৈরির প্রণালীতেও থাকে বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
একজন কর্তা বীভার, দু-তিনটি মাদী বীভার আর একগোছা বীভারছানা।এই এদের সংসার। একটু বড় হলে বাসা থেকে ছানাদের নিজের রাস্তা দেখে নিতে বের করে দেওয়া হয়।আদর্শ সন্তানের মত তারাও বেরিয়ে পড়ে।
একই জায়গায় বেশি ভীড় করে থাকলে খাবারের সংকট দেখা দেবে।তাই এরূপ পদক্ষেপ। তাই তারা কাছে পিঠে বাসাও তৈরি করে না। নিরুদ্দেশের পথে বেড়িয়ে খুঁজতে খুঁজতে বদ্ধ জলাশয় পেলে সেখানে বাসা বাধে যুবক বীভার। কোন মাদী বীভার সেটা দেখে বীভার যুবকের প্রেমে পড়ে যায়। সুখে শান্তিতে শুরু হয় নতুন সংসার।
কিন্তু যদি বদ্ধ জলাশয় না থাকে? ঠিক তখনই এদের 'ইঞ্জিনিয়ার' খেতাবের সত্যটা বোঝা যায়। প্রথমে ওরা একটা ছোটখাট জরিপ চালিয়ে নেয়। যেমন বৃষ্টি হলে জল কোনদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়, স্রোত কোনদিক থেকে আসে ইত্যাদি।
তারপর কুটুর কুটুর করে গাছ কেটে নামায়। দেহের তুলনায় তিন-চারগুন বড় গাছকে অনায়াসে কেটে নামিয়ে নিতে পারে। তারপর ছোট ডালপালা ফেলে গড়িয়ে নিয়ে এসে নদীতে জড়ো করে। এরপর পাথর গড়িয়ে এনে ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। সব শেষে কাদামাটি এনে ছোট ছোট ফাঁক-ফোকড় ও বন্ধ করে ফেলে।
বীভার লজ নামাঙ্কিত এই থাকার জায়গাটি হাত-পাঁচেক চওড়া এবং উপরের দিকে কিছুটা সুচালো হয়। বীভার কৃত তৈরি বাঁধ একটা গোটা অঞ্চলের বাস্তু বদলাতেও সক্ষম। উদাহরণও আছে-
নাভাদার সুজি ক্রিক। কুড়ি বছর আগেও জায়গাটা ছিল মরু অধ্যুষিত। প্রাণীর চিহ্ন ছিলনা বললেই চলে। জলের উপস্থিতি বলতে একটা সরু নালা। প্রচণ্ড দাবদাহ সেই জলও নিত শুষে।
সেখানে আগমন ঘটলো একদল বীভারের। আঠারোর তরুণ বলা সাজে। গড়ে উঠল তাদের সংসার। বদল এল জীব বৈচিত্রে। এখন সেখানে শুস্ক বালুরাশির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে গজিয়েছে কচি সবুজ ঘাসের মিছিল।
দূর থেকেই মাথা নাচিয়ে স্বাগত জানায় তারা। আর এসব সম্ভব হয়েছে একজনের জন্যেই- সেই ক্ষুদ্রকায় বীভার। মিউল হরিণ থেকে শুরু করে বিলুপ্তপ্রায় স্যান্ডগিল ক্রেন, নতুন প্রাণীরাও আসতে শুরু করেছে সবুজের ডাকে।বিভিন্ন হাঁসেরও চারণভূমি সুজি ক্রিক।
ইংরাজিতে বীভার শব্দটির অর্থ নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম। মূলত কানাডা ও উত্তর আমেরিকায় দুই প্রজাতির বীভার বাস করে।
উত্তর আমেরিকায় এক সময় ৬০ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক বীভার ছিল। কিছু অসাধু মুনাফালোভী চামড়া এবং পশম ব্যবসায়ীদের কারণে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬-১২ মিলিয়নে। এছাড়াও এদের গ্ল্যান্ড মেডিসিন এবং পারফিউম তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
প্রয়োজনেই সৃষ্টির উৎস – এই কথন বীভারদের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য। নিজের আকার ও অস্তিত্ব নিয়ে কুণ্ঠা না প্রকাশ করে পরিশ্রম ও মেধাকে পিঠে নিয়ে এদের লড়াই চলছে আর চলবে।