বঙ্গে এমন অনেক জায়গা আছে যার ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু অন্তরালেই থেকে যায়। ঠিক তেমনই হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক সমৃদ্ধ জনপদ বজবজের ঐতিহাসিক মাহাত্ম, যা এক সময়ে ছিল সুন্দরবনের অংশ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে স্মৃতি বিজড়িত খুকি মা'র মন্দির সহ একাধিক স্মৃতি বজবজের ঐতিহাসিক মাহাত্ম্যকে তুলে ধরেছে। ঠিক তেমনি শতাব্দীর কালপ্রবাহে বজবজের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে বাওয়ালি রাজবাড়ি। কলকাতা থেকে ৩৩.৪ কিলোমিটার দূরে বজবজ রেলস্টেশন। স্টেশন থেকে রিক্সা করে কিছুটা পথ গেলেই দেখা মিলবে এই রাজবাড়ির।
‘বাওয়ালি’ নামের তাৎপর্য বেশ গভীর। কয়েকশো বছর আগে এই অঞ্চলটির নাম ছিল বাওয়ালি। এখানকার অধিবাসীরা ছিলেন বাওল সম্প্রদায়ভুক্ত। বন-জঙ্গলের ওপরই ছিল তাঁদের জীবন নির্ভরশীল। মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ করা ছিল তাঁদের প্রধান জীবিকা। বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়, বনের দেবী বনবিবির পুজো করতেন তাঁরা।
প্রায় চারশ বছর আগের কথা, তখন রাজত্ব করতেন মুঘল সম্রাট আকবর। তাঁর প্রধান সেনাপতি মান সিংহের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন সেনা আধিকারিক উত্তরপ্রদেশনিবাসী শোবা রাম রাই। সফলভাবে কৃষক বিদ্রোহ এবং দস্যুবৃত্তি দমন করার জন্য তাঁকে মুঘল প্রশাসন থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল সুদূর বাংলায় ৩ লক্ষ একর জমি এবং ‘মণ্ডল’ উপাধি দিয়ে। সেই সূচনা হল বাওয়ালিতে মণ্ডল বংশের জমিদারির।
কৃষ্ণের উপাসক এই পরিবারের উদ্যোগে বাওয়ালিতে বেশ কয়েকটি মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। তার মধ্যেই অন্যতম ১৭৭২ সালের তাদের প্রথম প্রতিষ্ঠিত কুলদেবতার মন্দির- শ্রী শ্রী রাধাকান্ত জিউর মন্দির, পরে স্থাপিত হলো ১৭৯৯ সালে শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দির। এছাড়াও আছে, নবরত্ন মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির – প্রত্যেকটি মন্দিরেই ঐতিহাসিক চিহ্ন সুস্পষ্ট। মোটামুটি ২৫০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল বাওয়ালি রাজবাড়ি। বিশালতাই সেই প্রাসাদের মূল আকর্ষণ। ঢোকার মুখে বড়ো সিঁড়ি, জমকালো থাম, প্রশস্ত উঠোন, বারান্দা মনকে নিয়ে যাবে অন্য এক রূপকথার যুগে। সেই প্রাসাদ এখন হেরিটেজ রিসর্ট। এই রাজবাড়ির বর্তমান মালিক অজয় রাওয়ালের উদ্যোগেই একাধিক পরিবর্তন এনে তাকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। যদিও এই প্রকল্পের সাফল্যের জন্য তার বেশ কিছু সময় লাগে। কারণ এই রাজবাড়ির ১৮ জন মালিক বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকায় তাদের যোগাযোগ করে সম্মতি গ্রহণে প্রায় ২ বছর লাগে।
তার পর সর্বসম্মতিক্রমে কাজ ২০১০ এ শুরু হয়। এই রাজবাড়ির আভিজাত্য ও আধুনিকতা বজায় রাখতে ইউ.কে, ইতালি, মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্থপতি এবং পরামর্শদাতাদের পরামর্শ নেওয়া হয়। স্থানীয় কারিগরদের 'আগা খান ফাউন্ডেশনে' প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেন নতুন মালিক। তার দক্ষতা ও পরিকল্পনায় এটি আজ হেরিটেজ হাউসের মর্যাদা পেয়েছে। আগে থেকে বুকিং করলে আছে রাত্রিযাপনের সুবন্দোবস্ত, রাজকীয় খাবারের আয়োজন, আছে শুটিং এর পর্যাপ্ত সুবন্দোবস্ত, স্পা সহ আধুনিক সাজসজ্জার ব্যবস্থা, আসবাবে সৌন্দর্যায়নের সাথে সাবেকিয়ানার এক অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে। সময়করে ঐতিহাসিক আভিজাত্যের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে আসতেই পারেন, তাতে লাগবে না পাসপোর্ট, না ভিসা - শুধু লাগবে সময় আর ইচ্ছে।