"জীবনের সব ক্ষেত্রেই আশীর্বাদ বিছিয়ে রেখেছেন ঈশ্বর। হৃদয়ের দরজা খোলা রাখলে তবেই পাওয়া যাবে তার সন্ধান।"
একদিন মাঝরাতে এই লাইনগুলি লিখেছিলেন তিনি। এক বিহ্বল বাবা-মা’র জন্য। যারা সুনামীতে হারিয়েছিল ঘর। ভেসে গিয়েছিল তাঁদের তিন সন্তান। কিন্তু জীবনের লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি সেই দম্পত্তি।
সুনামীতে পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের সন্তানস্নেহে আঁকড়ে আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছিল তারা। তিনি কলম উঠিয়েছিলেন তাঁদের জন্য। ‘সব রাস্তাই খোলা আছে, যে কোনও দিক দিয়ে তুমি আসতে পারো’।
জীবনকে এভাবেই দেখেন তিনি। লক্ষ্য স্থির করে প্রতিদিন এগিয়ে যাওয়া। এই পথে তিনি ক্লান্তিহীন। তিনি অমিতাভ। অমিত আভায় সদা উজ্জ্বল। কঠিনতম সময়েও স্বপ্ন দেখেন দিন বদলের। তাঁর কলম লেখে,"বারিশ কো জিতনা বরসনা থা বরস গয়ি, অব কুছ নয়ী হাওয়ায়েঁ চল পড়ী হ্যাঁয়"
শুরুতে তাঁর নাম ভাবা হয়েছিল ‘ইনকিলাব’। ভারত ছাড় আন্দোলনে 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' স্লোগানে মুখর দেশ, তাঁর বাবা হরিবংশ রাই বচ্চনের এক বন্ধু বলেছিলেন, ছেলের জন্ম হলে নাম 'ইনকিলাব'। পরে বদলে যায় সেই নাম। বিখ্যাত কবি সুমিত্র নন্দন পন্থ নাম রাখেন 'অমিতাভ'। স্কুলের খাতায় নামটা হয়ে যায় 'অমিতাভ'। চেয়েছিলেন এঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ‘ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স’-এ যোগ দেবেন, কিন্তু তাঁর মা চাইতেন ছেলে মঞ্চের মাঝখানে থাকুন। মায়ের ইচ্ছেই সাঁঝবাতির আলো হয়ে পথ দেখিয়ে ছিল তাঁকে। সেই নিয়তির পথে হয়ে গেলেন অভিনেতা। এমন অভিনেতা যাঁর সামনে আনত হয় সারা দুনিয়া। ‘দ্য বিগেস্ট স্টার অমিতাভ বচ্চন’!
দু’ হাতেই সমান দক্ষতায় লিখতে পারেন। জীবনের সব ক্ষেত্রেই সেই অসামান্যতা। যে উচ্চতা আর কণ্ঠের জন্য বারবার প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল প্রথম জীবনে, সেই কণ্ঠ আর উচ্চতাই তাঁর কাছে সেরা সম্পদ।
১৯৬৯-এ অভিনয় করলেন ‘সাত হিন্দুস্তানী’ ছবিতে। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সেই ছবিতে অভিনয়ের জন্য, কিন্তু ছবির কেরিয়ারে ঘুরে দাঁড়াতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও ২ বছর। তারপর সুযোগ পেলেন ‘আনন্দ’ আর ‘জঞ্জির’ ছবিতে।
প্রথম হিট ছবি ‘জঞ্জির’। তার আগে এক ডজন ছবি টানা ফ্লপ। কোনও পরিস্থিতিতেই লড়াইয়ের মঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। স্টার-সুপারস্টার-মেগাস্টারের বিশেষণ নামের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার পরেও এসেছে ভাঙন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। বাজারে ঋণ, ছবি ফ্লপ! কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।নিজেই গিয়েছিলেন যশ চোপড়ার কাছে, তিনি তখন ‘মহব্বতেঁ’ ছবির পরিকল্পনা করছেন। অমিতাভ বললেন, ‘কাজ করতে চান’। কেরিয়ার শুরুর সময় ঠিক যে আশা-আশঙ্কায় ঘড়ির কাঁটা গুনতেন ঠিক সেরকম। আজও যেন ঠিক সেই আসনেই বসে। ‘মহব্বতেঁ’ ব্লকবাস্টার হিট! ফের যেন বলিউড অভিষেক ঘটল তাঁর। কেরিয়ারের স্টেয়ারিং ফের নিজের নিয়ন্ত্রণে। আরও এক চ্যালেঞ্জ নিলেন তিনি। ছোটপর্দায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্যুইজ শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ হোস্ট করবেন তিনি। স্ত্রী জয়া বচ্চন খুব সহমত ছিলেন না তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে। বলিউডের শাহেনশাহ ছোট পর্দায় দশর্কদের মুখোমুখি হবেন মানতে পারেননি তিনি। অমিতাভ সহধর্মিনীকে বলেছিলেন, ‘বেগার কান্ট বি চুজার্স’।
ভারতীয় টেলিভিশনে ইতিহাস তৈরী করেছিল সেই শো। মুখে মুখে ফিরত তাঁর ‘লক কিয়া জায়’। ২০০০ সালে শুরু হওয়া শো আজও মাইলস্টোন। ১৪ সিজন পেরিয়ে, ২২ বছর ধরে টেলিভিশনের সেরা শো। অমিতাভ সেরা উপস্থাপক। তাঁর আসনে আর কাউকে মেনে নেয়নি দর্শক।
যতবার বাধা এসেছে ততবার তা পার করেছেন দ্বিগুণ পরাক্রমে। আজও তাই মাঝরাত পেরিয়েও শুটিং-এ তিনি ক্লান্তিহীন। দিন শেষে কবিতার লাইনে ভরে ওঠে তাঁর ওয়াল। এখানেও তিনিই সেরা!
অমিতাভ বলেন, দুর্ভাগ্য তোমায় শেষ করে দেবে, নাহলে তোমায় চিনিয়ে দেবে, সত্যিই তুমি আসলে কে’। নিজের ব্যর্থতা, দোষ ত্রুটি সব কিছু মেনে নিয়েই সাফল্যের দিকে পাখির চোখ করেছিলেন। পরিশ্রম আর নিজেকে ধারালো করে তোলা এছাড়া তৃতীয় কোনও অস্ত্র ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জো হো গ্যায়া সো হো গ্যায়া...আমি শুধু একটা কথাই বলি আগের ভুল আর যেন না হয়...’