‘১৯৬৯’ প্রবাদ হয়ে আছে জনপ্রিয় গানের দল ঈগলস এর গানে। ১৯৬৯ বিশ্ব ইতিহাসে ‘আইকনিক ইয়ার’। ভারতের ইতিহাসেও।
ভারতীয় সিনেমায় এই বছর মোড় ঘোরানো এক বছর। রাতারাতি বদলে দিয়েছিল ভারতীয় সিনেমা এবং দর্শকদের।
নেপথ্যে দুই বাঙালি। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় আর বাসু চট্টোপাধ্যায়। মায়ানগরী তাঁকে চিনেছিল অবশ্য ‘ বাসু চ্যাটার্জী’ নামে। মেলোড্রামার গরগরে চড়া স্বাদে অভ্যস্ত হিন্দি সিনেমার দর্শকদের ভালো লেগে গিয়েছিল তাঁর অন্য স্বাদের টক-ঝাল-মিষ্টির গল্প।
সেলুলয়েডের দুনিয়ায় বাসু চট্টোপাধ্যায়ের প্রবেশ কিন্তু বেশ দেরী করেই। জন্মসূত্রে প্রবাসী বাঙালি। জন্ম ১৯৩০-এ রাজস্থানের আজমীরে। কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ইলাস্ট্রেটর এবং কার্টুনিস্ট হিসেবে। চাকরি করতেন মুম্বইয়ের উইকলি ট্যাবলয়েড ব্লিৎজ-এ। আঠারো বছর টানা কাজ করেছেন।
১৯৬৬-তে বাসু ভট্টাচার্যের ছবিতে সহ পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন। ছবির নাম ‘তিসরি কসম’। অভিনয়ে রাজ কাপুর, ওহাদিয়া রহমান। ১৯৬৯- শুরু করলেন নিজের ছবি। রাজেন্দ্র যাদবের কাহিনী ভিত্তি করে ‘সারা-আকাশ’। এক অসুখী দাম্পত্যের গল্প।
তিনি যে সময়ে ভারতীয় সিনেমায় পা রাখেন সেই সময়টা বড় টালমাটাল। ৭০ এর দশক। উদ্দাম। অস্থির। দ্রুত বদলে যাচ্ছে চারপাশ। সমাজ- অর্থনীতি বদলের স্রোতে মিশেছে। তার প্রভাব পড়েছে সংস্কৃতিতেও। সাগর বেরিয়ে আসা হিপি কালচার আছড়ে পড়েছে বাণিজ্য নগরীর মাটিতে। সেই ঢেউ ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো ভারতককে। অনভ্যস্ত চোখে চিনতে শিখছে নারীবাদের ধারণা। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সোচ্চার সুর। মেয়েরা বেরিয়ে আসছে চারদেওয়ালে বন্দি জীবন ছেড়ে। কর্ম সংস্কৃতিতে স্তম্ভের মতো হয়ে উঠছে তাদের সদর্প উপস্থিতি। নাগরিক জীবনের মেইনস্ট্রিম মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে তাদের দক্ষতা। ঘরকন্না থেকে কর্ম ক্ষেত্র সম্পর্ক, প্রেম, দাম্পত্য নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশে জড়তাহীন তারা। এই সন্ধিক্ষণকে চিনে ছিলেন বাসু চট্টপাধ্যায়। সেই গল্পই বলতে চেয়েছিলেন তিনি।
নিজেকে পুরোপুরি ‘বিমল রায় স্কুল’-এর ছাত্র মনে করতেন। গল্প বলার ধরন ছিল তেমনই। সহজ সরল টানটান। অথচ ছুঁয়ে যায়।
তাঁর সিনেমা আধুনিক মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প। নারী চরিত্ররা সেজে উঠেছে সেভাবেই। হালকা সাজ, শিফন শাড়ি, রিস্ট ওয়াচে ছিমছাম শহুরে আধুনিকা। তারা রাস্তায় হেঁটে যায়। ভিড় বাসে কোণ খুঁজে দাঁড়ায়। অপেক্ষার লাইনে অধৈর্য হয় আবার বৃষ্টির দিনে ঝমঝমিয়ে ভেজে। তাদের প্রেমিকরাও অতিমানবিক ‘হিরো’ নয়। দোষ, ত্রুটি, পিছিয়ে পড়ায় রক্ত মাংসের মানুষ।
এ যেন এক আবিষ্কার। ছোট ছোট আবেগকে এই সূতোয় গেঁথে তৈরি হতে ‘বাসু চ্যাটার্জীর সিনেমা’। চারপাশের জগৎটাকে চিনেছিলেন ইলাস্ট্রেটরের দৃষ্টি দিয়ে। সেই দৃষ্টিতেই গভীরতা পেয়েছে চিত্রনাট্য। সেখানে চড়া রঙের চাপিয়ে দেওয়া পরত নেই, বরং আছে শীতল পাটির স্নিগ্ধতা। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের সেই স্নিগ্ধতাই চুম্বকের মতো টেনে রাখে। সাধারণ জীবনের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প।
বড় পর্দার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব ছাপ রেখেছেন ছোট পর্দাতেও। ১৯৮৫ সালে নারী ক্ষমতায়নের কাহিনীতে বাসু চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন ‘রজনী’ ৷ নাম ভূমিকায় প্রিয়া তেন্ডুলকার। ভারতীয় টেলিভিশনে তা আজও মাইলস্টোন হয়ে আছে। দূরদর্শনের জন্য শরদিন্দুর ব্যোমকেশকে এনেছিলেন হিন্দিতে। টেলিভিশন সিরিজ। 'ব্যোমকেশ' হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন রজত কাপুরকে। আজও তার জনপ্রিয়তা অম্লান।
বাসু চ্যাটার্জী আসলে বয়ে যাওয়া এক ইতিহাস। তাঁর প্রয়াণে থেমে গেল নিউ এজ হিন্দি ছবির প্রথম স্রোতের ধারা।