বসন্ত বয়ে চলেছে। তাই শিমূলের ডাল ফুলে ফুলে লাল, পলাশের বন ফুলে ফুলে ঢাকা। ঝিরি ঝিরি বাতাস গুনগুনিয়ে অহরহ সুর তুলছে, 'ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে'। পুরাণ বলছেন ঋতু বসন্তের জন্ম কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। তার যথেষ্ট কার্যকারণ আছে। আর সেটাই হচ্ছে গল্প। সেই গল্পটিই এখন বলব :
যে সময়ের কথা বলছি, সে-সময় ত্রিলোক দাপাচ্ছিল তারকাসুর। সে এ-সময় এমন অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল যে, তার অত্যাচারে দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। তাঁরা বুঝলেন, এই অসুরকে বধ না-করতে পারলে কিছুতেই তাঁদের মুক্তি নেই। কিন্তু, তাকে বধ করা বড় কঠিন কাজ। কারণ, ব্রহ্মার বরে তাকে বধ করতে পারবেন একমাত্র মহাদেবের ঔরসজাতপুত্র। আর সেখানেই যত গণ্ডগোল। কেন?
কেন নয়? মহাদেবের যে সংসারে একেবারেই মন নেই, বিয়েরও কোন ইচ্ছে নেই, দিনরাত যোগসমাধিতেই মগ্ন থাকেন। বিয়ে না করলে পুত্র হবে কোথা থেকে? পুত্র না হলে দেবতারা মুক্তি পাবেন কেমন করে?
দেবতারা পড়লেন মহা আতান্তরে। তাঁরা শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মদেবের। ব্রহ্মা আর উপায় না-দেখে মদনদেবকে আদেশ দিলেন শিবের ওপর মদনবাণ প্রয়োগ করতে।
তখন রতিদেবীকে সঙ্গে নিয়ে মদনদেব কৈলাসে হাজির হলেন। কিন্তু, কৈলাসে তাঁর জন্য যে কেলেঙ্কারিটি অপেক্ষা করে আছে, সেটি আর মদনদেব আন্দাজ করে উঠতে পারলেন না।
যাই হোক, মদনদেবের প্রথমেই মনে হল, শিবকে কামবাণে ঘায়েল করার আগে প্রকৃতিকে সেভাবেই সাজিয়ে তুলতে হবে। যাতে শিবের মনে কামনা জাগানোর উপযোগী আবহ তৈরি হয়। আর এটা করতে গিয়ে তিনি ঋতুচক্রে একটি নতুন ঋতুই সৃষ্টি করে ফেললেন। সেই ঋতুর নাম দেওয়া হল, 'বসন্ত'।
বসন্তের আবাহনে তখন ধরায় মলয় বাতাস বইল, গাছে গাছে নতুন পাতা মুকুলিত হল, শাখায় শাখায় পুষ্প মঞ্জরী এল। কোকিল পঞ্চমে গেয়ে উঠল গান।
প্রকৃতির এই আবহেই মহাদেবকে লক্ষ্য করে শর নিক্ষেপ করলেন মদনদেব। শরাঘাতে ধ্যানভঙ্গ হল মহাদেবের, অসময়ে ধ্যান ভেঙে অসম্ভব ক্রোধ হল তাঁর। সেই ক্রোধের আগুন নির্গত হল তাঁর তৃতীয় নয়ন দিয়ে। সেই আগুনে ছাই হয়ে গেলেন কামদেব। কিন্তু তাঁর কামশর যেহেতু মহাদেবকে ছুঁয়েছে, সেহেতু মহাদেবের মনে জাগল প্রবল কামনা। এবার তাঁর বিবাহের বাসনা হল।
তখন দেবতারা হিমালয় কন্যা পার্বতীর সঙ্গে ঘটা করে তাঁর বিয়ে দিলেন। তারপর অল্পদিনেই শিব-পার্বতীর পুত্র কার্তিকেয়র জন্ম হল। এই কার্তিকেয়ই তারকাসুরকে বধ করে ত্রিলোকে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
মদনদেব নিজের জীবন উৎসর্গ করে পার্বতীকে শিবের মতো বর জুটিয়ে দিয়েছিলেন বলে প্রাচীনকালে কুমারী মেয়েরা বিয়ের আগে এই বসন্তের সূচনায় মদনদেবের পুজো করতে শুরু করলেন। এই পুজো উপলক্ষে যে উৎসবের আয়োজন শুরু হল, তাকে বলা হতে লাগল, 'মদন-উৎসব'। মদনভস্ম ও বসন্তের জন্ম প্রায় একই সময়ে হয়েছিল বলে এই উৎসবকে বসন্ত সূচনার উৎসব অর্থাৎ 'বসন্ত উৎসব' বলেও অভিহিত করা হতে লাগল। উৎসবটি হয়ে উঠল ফুল আর প্রকৃতির রঙে রঙিন।
কাহিনিসূত্র : ব্যাসদেব রচিত, 'শিব পুরাণ'।