দিনটা ছিল রবিবার। দুপুর বেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে ইংরেজরা তখন সবে মাত্র একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। সময়টা ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ।
বাংলার ব্যারাকপুরের প্যারেড গ্রাউণ্ডে দুপুরবেলায় একটু একটু করে লোকজনের ভিড় বাড়ছে। থমথমে পরিবেশ। কেউ জানে না কী হতে চলেছে।
চারিদিকে একটা চাপা গুঞ্জন। আর সেই গুঞ্জনের মধ্যেই ৩৪ নম্বর ইনফ্যান্টট্রির সিপাহীরা দলে দলে একত্রিত হতে লাগলেন।
কেউ বন্দুক হাতে। কেউ বা খালি হাতে। কিন্তু সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বিশেষ একজনের দিকে। যেন ঝড় শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত। সবাই অপেক্ষা করছে সেই বিশেষ মানুষটির বিশেষ বার্তার উদ্দেশ্যে।
ছয় ফুট উচ্চতার বলিষ্ঠ দেহধারী সেই বিশেষ মানুষটি বন্দুক কাঁধে নিয়ে টহল দিচ্ছেন প্যারেড গ্রাউণ্ডের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত। সকলের চোখ তাঁর দিকে। তিনি ইংরেজদের ত্রাস মঙ্গল পাণ্ডে।
তারপর একসময় এই সুদীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান হল। আকাশের দিকে চিবুক তুলে তীব্র কণ্ঠে বললেন, "বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গির পায়ের তলায় আর কতদিন থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের মাতৃভূমি লুটেপুটে খাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভাইসব এই সব ফিরিঙ্গিদের মারো।"
ব্যাস! এইটুকুরই অপেক্ষা ছিল এতদিনের পুঞ্জীভূত জনরোষ সেদিন সিপাহী_বিদ্রোহের রূপ ধরে ইংরেজদের গদিকে অনেকখানি টলিয়ে দিয়েছিল। মঙ্গল পাণ্ডেই সেই দিন সকল সিপাহীদের ব্যারাকপুর প্যারেড গ্রাউণ্ডে ডেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ডাক দেন। কিন্তু ততক্ষণে ইংরেজ শিবিরে খবর পৌঁছে গিয়েছে।
মঙ্গল পাণ্ডেকে প্রতিহত করার জন্য একের পর এক ইংরেজ আসতে থাকেন। প্রায় প্রত্যেকেই মঙ্গল পাণ্ডের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। তবুও শেষ রক্ষা হয় না।
দিনের আলো তখন নিভে এসেছে। অবসন্ন ক্লান্ত দেহে তখন যুদ্ধ করার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হতেফুরিয়ে এসেছে। আর ঠিক সেই সময় তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেন ব্রিটিশ সেনাপতি হিয়ার্সে। কিন্তু বীর মঙ্গল পাণ্ডে কিছুতেই অত্যাচারী ইংরেজদের কাছে পরাজয় স্বীকার করবেন না।
ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। নিজের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে শেষবারের মতো মাতৃভূমিকে প্রণাম করেন মঙ্গল পাণ্ডে। তাঁর পিস্তল গর্জে ওঠে। কিন্তু মৃত্যু অত সহজে ধরা দেয় না তাঁর কাছে। গুলি মাথা ফসকে বেরিয়ে যায়। ধোঁয়া, বারুদ ও আগুনের মধ্যে তাঁর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পাড়লেও প্রাণটুকু তাঁর দেহে থেকেই গেল।
তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ইংরেজ শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল সুস্থ করে আরও নির্মমভাবে শাস্তি দেওয়া। ৬ এপ্রিল। ইতিহাসের পাতায় এক কলঙ্কিত অধ্যায় লেখা হল। বিচারের নাম হল প্রহসন।
৮ এপ্রিল সকালবেলায় অসুস্থ, মুমূর্ষু মঙ্গল পাণ্ডেকে ব্যারাকপুরে সমস্ত সৈনিকদের সামনে ইংরেজ সরকার তাঁকে ফাঁসীর মঞ্চে ঝুলিয়ে দিল। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইলেন সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহিদ মঙ্গল পাণ্ডে। এই ঘটনা সমগ্র দেশের সিপাহীদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্বের কফিনে এই বিদ্রোহ শেষ পেরেক পুঁততে না পারলেও প্রথম পেরেক পোঁতার কাজটা করেছিল বৈকি।