বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা লোকনাথ

ভক্তের ভগবান তিনি, বাবা লোকনাথ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন এই মহাপুরুষ। জয় বাবা লোকনাথ, জয় মা লোকনাথ, জয় শিব লোকনাথ, জয় ব্রহ্ম লোকনাথ, জয় গুরু লোকনাথ। ১৭৩০ সালে, বাংলা ১৮ই ভাদ্র, ১১৩৭ বঙ্গাব্দে জন্মাষ্টমী তিথিতে কলকাতা থেকে কিছু দূরে চৌরাশি চাকলা নামক গ্রামে একটি ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মগ্রহন করেন লোকনাথ ঘোষ। কেউ কেউ কচুয়াকেও তাঁর জন্মভূমি বলেন। তাঁর পিতার নাম রামনারায়ন ঘোষাল। এবং মা কমলাদেবী। তিনি ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের চতুর্থ পুত্র।
 
মহাজ্ঞানী ভগবান গাঙ্গুলীকে লোকনাথ গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন। শৈশবে উপনয়নের পরেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। উদ্দেশ্য ছিল ঈশ্বর সাধনা। বাল্যবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির বেনীমাধবও তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। ভগবান গাঙ্গুলী তাঁদের প্রাথমিক শিক্ষাদান আরম্ভ করলেন কালীঘাটে। এই স্থান তখন সাধু সন্ন্যাসীতে পরিপূর্ণ। এই দুই বালকের শিশুসুলভ দুষ্টুমি তখনও যায়নি। কোনসময় সাধুদের জটা ধরে টানে, কোনসময় তাঁদের জামা ধরে টানে এবং সন্ন্যাসীদের ধ্যান ভঙ্গ করে দেয়, এতেই চলে কিছুদিন। বিভিন্ন স্থান ঘুরে তারা হিমালয়ের দিকে রওনা দেন। গুরুর নির্দেশ মতো হিমালয়ের বরফাকৃত নির্জন স্থানে লোকনাথের যোগসাধনা চলতে থাকে। বছরের পর বছর দীর্ঘ সাধনার পর একদিন লোকনাথ ব্রহ্মদর্শন করলেন। তাঁর সিদ্ধিলাভ হল। ব্রহ্মচারী লোকনাথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেন। সার্থক গুরু মহাজ্ঞানী ভগবান গাঙ্গুলী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে মহাতীর্থ কাশীধামে আসেন এবং এখানেই মণিকর্ণিকার ঘাটে মহাজপে উপবিষ্ট অবস্থায় গুরু দেহত্যাগ করেন। ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার দেশভ্রমণ শুরু হল এবং বিভিন্ন স্থান ঘুরে তিনি মুসলমান তীর্থস্থান মক্কা ও মদিনা দর্শনে উপস্থিত হলেন। হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রীষ্টান সব ধর্মের লোকরাই তার কাছে সমান। তখন তাঁর গুরু কাশির জীবন্ত শিব তৈলঙ্গ স্বামী।
 
লোকনাথ আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা ইত্যাদি স্থান অতিক্রম করে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখানেই আবদুল গফুর নামের এক মহাপুরুষের দর্শন লাভ করেন এবং লোকনাথ বাবা দিন কয়েক তাঁর সংসর্গে কাটান। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান যেমন হরিদ্বার, বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী প্রভৃতি ছাড়াও আফগানিস্থান, পারস্য, আরবদেশ, গ্রীস, তুরস্ক ঘুরে লোকনাথ বাবা আবার ভারতে ফেরেন। পরে তিনি বেণীমাধবকে সাথে নিয়ে উত্তরের পথে গমন করেন। তারা সুমেরু এলাকা গমনের ইচ্ছায় প্রাক-প্রস্তুতি উপলক্ষ্যে শৈত্যপ্রধান এলাকা হিসেবে বদরিকা আশ্রমে অবস্থান করে সেখান থেকে সীমা অতিক্রম করে উত্তরে বহুদূরে চলে যান। তারপর তারা চন্দ্রনাথে আসেন কিছুকাল থেকে বেণীমাধব কামাখ্যায় এবং লোকনাথ বারদী গ্রামে গমন করে বাস করতে থাকে। সে সময় থেকেই "বারদী'র ব্রহ্মচারী" হিসেবে লোকনাথ পরিচিতি পান।
 
কাশীধামের শ্রী শ্রী তৈলঙ্গস্বামী হাতে প্রিয় শিষ্যদের ভার সমর্পণ করে গুরু ভগবান দেহত্যাগ করেছিলেন। তাই স্বামীজীর কথায় লোকনাথ নিম্নভূমিতে যাত্রা করেন। লোকনাথ বাবা আসাম হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সে সময় চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী হঠাৎ ভীষণ দাবানলের মধ্যে আটকে পড়েন এবং লোকনাথ বাবা তাকে উদ্ধার করেন। এখান থেকেই বেনীমাধব ও লোকনাথ পৃথক হয়ে নিজ নিজ পথে চললেন। আলাদা হল দুই বন্ধুর পথ।
 
ত্রিপুরা জেলার দাউদকান্দি গ্রামে এক বৃক্ষের ছায়ায় বাবা অবস্থান করেন। সামনে দিয়ে অনেক লোক যায়, কেউ তাঁকে দেখে পাগল ভাবে কেউ ভিখিরি, কেউ কেউ দয়া পরবশ হয়ে ফলমূল খেতে দেয়। অপরাধী ডেঙ্গু কর্মকার যার বিচারে প্রাণদন্ড হওয়ার কথা। বাবার কৃপায় তাঁর মুক্তি হয়। বাবা বললেন তুই মুক্তি পাবি এবং পরদিন বিচারে সে নিদোর্ষ বলে খালাস পায়। ডেঙ্গুর অনুরোধে লোকনাথ বাবা বারদী গ্রামে আসতে রাজি হন। বারদীতে সকলেই লোকনাথ বাবাকে নীচ জাতি, পাগল ও অপবিত্র বলে মনে করে। একদিন কয়েকজন ব্রাহ্মণ গ্রন্থি দিতে গিয়ে তাদের পৈতেতে জট ফেলেছেন আর খুলতে পারছেন না। লোকনাথ বাবা তাঁদের দিকে যেতেই তারা রেগে তাকে দূর হয়ে যেতে বললেন। বাবা কিন্তু হাসিমুখে তাদের বললেন তর্ক না করে তোমাদের গোত্র বল। গোত্র শুনে বাবার গায়ত্রী জপে সব জট খুলে গেল। সাধুরা বুঝলেন ইনি মহাপুরুষ এবং লোকমুখে বাবার প্রচার শুরু হয়ে গেল। বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় বাবার পছন্দ করা স্থানে নিষ্কর জমিতে বাবার জন্য আশ্রম করে দেন। আশ্রমের পাশে থাকতেন এক গোয়ালিনী মা তিনি প্রতিদিন বাবার জন্য দুধ আনতেন। লোকনাথ বাবা তাঁকে মায়ের মর্যাদা দিয়ে আশ্রমে থাকতে বললেন। যোগবলে লোকনাথ বাবা জেনেছিলেন যে পূর্ব জনমে এই গোয়ালিনী মা ছিলেন তাঁর প্রকৃত মা। 
 
"শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী" বাবার আশ্রমে প্রতিনিয়ত ভক্তের সমাগম বাড়তে থাকল। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ও জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী, রাজা মহারাজারা বাবার দর্শন ও আশীর্বাদের জন্য আসতে থাকেন। একদিন ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুর লোকনাথ বাবার একটি ছবি তোলার অনুমতি চাইলেন। বাবা প্রশ্ন করেন যে তাঁর ছবি দিয়ে কি হবে। ভাওয়ালের রাজা বলেন যে তাঁর ছবি সাধারণ মানুষ এবং বাবার ভক্তদের প্রয়োজনে লাগবে, প্রতি ঘরে ঘরে পুজো হবে, মানুষের সংসার চলবে। বাবা অনুমতি দিলেন এবং তিনি একটি মাত্র ছবি তোলেন। বাবার ওই একখানি ছবিই আজ সর্বত্র পূজিত হচ্ছে। আমরা তা দেখতে পাই এবং সংগ্রহ করি। বাবার কৃপায় অসংখ্য মানুষ উপকৃত হতে থাকেন। বাবার আশীর্বাদে ভক্তদের দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়, বাবার ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে, ঘরে ঘরে বাবার পুজো শুরু হয়। বাঘের মিছরি খাওয়া, মরণ ব্যাধি দূর করা বারদী আস্তে আস্তে পুন্য ভূমি হয়ে ওঠে।
 
বাবা বুঝতে পারেন তাঁর মৃত্যুর ক্ষণ আসন্ন। ১৯ জ্যৈষ্ঠ রবিবার, আকাশ সম্পূর্ণ পরিস্কার। বাবা আগেই আশ্রমের সবাইকে সকাল নয়টার মধ্যে আহার করে নিতে বলেছেন। মা আজও পুত্রের জন্য বাল্যভোগ প্রস্তুত করলেন। বাবা নিজের হাতে খেয়ে প্রসাদ করে ভক্তদের দিলেন। আশ্রমের সকলের আহারাদি শেষ। বাবা বেলা ১১:৪৫ মিনিটে মহাযোগে উপবেশন করলেন। দেহত্যাগের মাধ্যমে তিনি তাঁর স্থূল দেহ ত্যাগ করে সূত্র দেহ ধারণ করে, ফিরে গেলেন সৃষ্টিলোকে। যদিও ভক্তদের বিশ্বাস তিনি ত্রিলোকে বিরাজ রইলেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...