১৯৭৪ সাল। সবে পা দিয়েছেন বোম্বাইতে। ঝুলিতে একটাই ছবি। তাতে কী!
তখন প্রতিটা দিনই নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চার বাপীর কাছে। মানে বাপ্পি লাহিড়ীর কাছে। একদিন সমু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গেলেন কিশোর কুমারের বাড়ি।
দিদি বাঁশরি লাহিড়ীর গানপাগল ছেলেটির সম্পর্কে মামা কিশোর। তাই বাড়িতে হঠাৎ ভাগ্নাকে দেখে বেজায় খুশি!
বলিউডে নবাগত ‘বাপ্পি’র সঙ্গে মিলেজুলে পরিচালক সমুর কিশোরের বাড়িতে যাওয়া নিজের আগামী ছবিতে প্লে-ব্যাকের প্রস্তাব নিয়ে।
ছবির কথা শুনে ‘না’ করলেন না কিশোর, কিন্তু তাঁর একটা শর্ত আছে।
বাপ্পি যদি কিশোরের আসছে ছবিতে অভিনয় করে তবেই সমুর ছবিতে গাইবেন কিশোর। বাপীর রাজি না হয়ে কোনও উপায় ছিল না। কিশোরের নিজের লেখা কাহিনি নিয়ে ছবি ‘বড়তি কা নাম দাদি’। মুখ্য অভিনেতাও তিনিই। ছেলে অমিতকুমারও আছেন সহ অভিনেতা হিসেবে। সেই দলে বাপ্পি কেও নিলেন।
১৯৫৮-তে রিলিজ হওয়া ‘চলতি কা নাম গাড়ি’র সঙ্গে নামে মিল আছে ‘বড়তি কা নাম দাদি’র। ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবিতে কিশোর আর তাঁর দুই ভাই অনুপ আর অশোক কুমারকে দেখা গিয়েছিল মুখ্য ভূমিকায়।
এই ছবি দিয়েই বলিউডে অভিনেতা হিসেবে ডেবিউ করেছিলেন বাপ্পি ।
মামার জোরাজুরিতে অভিনেতা হিসেবে ক্যামেরার সামনে এলেও গান ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাবনা আসেনি মাথায়। পরীক্ষানিরীক্ষার ইচ্ছেও হয়নি।
গানের টানেই যে কলকাতা ছেড়ে বোম্বাই আসা। ‘বাপী’ থেকে ‘বাপ্পি’ হওয়া। মা-বাবাও সেই স্বপ্নের শরিক হতে শহর ছেড়েছিলেন তাঁর সঙ্গে।
১৯৫২তে জলপাইগুড়ি শহরে জন্ম।
শুরুতে নাম দেওয়া হয় ‘বাপী’। সেই নাম কাকিমা মীরা লাহিড়ীর দেওয়া। পরে বদলে যায় ‘বাপ্পি ’তে। বদলের নেপথ্যে প্রযোজক সমু মুখোপাধ্যায়।
বাবা অপরেশ লাহিড়ি। মা বাঁশরি লাহিড়ী। দুজনেই গানের মানুষ। কলকাতা-বোম্বাইয়ের ডাকসাইটের গাইয়ে-বাজিয়েরা নিয়মিত আসতেন বাড়িতে। সেভাবেই একদিন লতা মঙ্গেশকরের নজরে পড়ে গেল ছোট্ট বাপি। সবে হাঁটতে শিখছে ছেলে, কিন্তু তালজ্ঞান বড়দের হার মানায়!
লতার পরামর্শেই পাঁচ বছর বয়সে তবলার ক্লাসে নাড়া বাঁধা। গুরুজী পন্ডিত সামতা প্রসাদ। যাই সেখান ঝটপট শিখে নেয় ছাত্র। ভীষণ মনোযোগ। বয়স তখন সবে দশ পেরিয়েছে, একটা গোটা গানে সুর দিয়ে ফেলল ছেলে। ছেলের সুরে গান গাইলেন বাবা। বাংলা গান।
সব আগ্রহ গান নিয়েই। তখন থেকেই সুরই জীবন। তাই ১৯৭২-এ যখন ছবির গানে সুর দিলেন কিশোর বাপী কেউ এতটুকু অবাক হয়নি। ছবির নাম ‘দাদু’।
প্রশংসা এলো খুব। বাবা-মা পরিবার সবাই খুশি। কিন্তু যাকে নিয়ে এত কিছু তার ছটফটানি কমল না। তার চোখে যে জ্বলজ্বল করছে মায়ানগরীর আলোর টান। স্বপ্ন হিন্দি ছবির গান তৈরি করবে।
বাবা-মা দুজনেরই বাস গান জীবনে। তাই ছেলের স্বপ্নে বাধা তো এলোই না, বরং ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে পাড়ি দিলেন আরব সাগরের তীরের নগরীতে।
খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। পরের বছরই এলো সুযোগ। ১৯৭৩-এ ‘নানহা শিকারী’ ছবি দিয়ে সুরকার হিসবে বলিউড ডেবিউ হল একুশের টগবগে তরুণ বাপীর। ততদিনে নাম বদলে ‘বাপ্পি ’।
ছবি তুখোড় হিট হল না। কিন্তু ছবির গান ‘তুহি মেরি চন্দা, তুহি মেরি তারা’ আর আশা-কিশোরের গলায় ‘তুহি মেরি মঞ্জিল’ বেশ মন ছুঁয়ে ছিল ইন্ড্রাস্ট্রির।
কিশোর স্নেহ করতেন বাপ্পি কে। দুজনেই একসঙ্গে কাজ করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। ইন্ড্রাস্ট্রিকে ‘হিট’ও দিয়েছেন একের পর এক। ‘নমক হালাল’ ছবির ‘পাগ ঘুংরু বাঁধকে’ আর ‘মঞ্জিলেঁ অপনি জাগহা হ্যায়’ শুনে নড়ে গিয়েছিল বলিউড। এই ছবির গানের জন্য ফিল্মফেয়ার সম্মান পেয়েছিলেন কিশোর আজও সেই গান টপ রেটিং-এ। ‘দে দে প্যার দে’, ‘ইন্তেহা হো গয়ি’, ‘লোগ কহতে হ্যায়’ এরকম কত...!
‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রখনা, কভি আলবিদা না কহনা’ কিশোর-বাপ্পি জুটির এই গানের কাছে বারবার ফিরে আসতে হয় গানপ্রেমীদের।
কিশোরের শেষ কাজও বাপ্পির সঙ্গেই। ‘গুরু গুরু’ গানে গলা দিয়েছিলেন আশা ভোঁশলের সঙ্গে। মিঠুন-শ্রীদেবী অভিনীত ছবির নাম ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’। পরদিনই কিশোর-বিদায়ের খবর আছড়ে পড়েছিল এদেশের ওপর।
মামার কথা বলতে গিয়ে ভাগ্না বাপ্পি বলেন, “কিশোর কুমার এক হি থে। উহ আয়ে আউর চলে গয়ে। কিশোর কুমার কভি দোবারা নেহি আয়েঙ্গে...”