বাংলা চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট ও ক্ষণজন্মা চিত্রপরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা চলচ্চিত্রে চিত্রপরিচালনার বৃন্তে যখন একটি বিশিষ্ট নাম হয়ে উঠেছিলেন বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়; ঠিক তখনই অকালে প্রয়াত হয়েছিলেন তিনি, ২০১৫ সালে, ২৮ আগস্ট, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। বাংলা চলচ্চিত্রে বাপ্পাদিত্য নিজস্ব একটি গল্পবলার রীতি তৈরি করেছিলেন; যেখানে বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ, যেখানে ভূমিরূপ কথা বলে, যেখানে এসে পড়ে লোকজীবনের সুর ও সংস্কার, যেখানে নিটোল গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে পরাবাস্তবতার ব্যঞ্জনা।

বাপ্পাদিত্যের ছবির গল্প কখনো নিজের লেখা, কখনো বাবা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের, কখনো বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন। ‘পোকাদের আত্মীয়স্বজন’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থও রয়েছে। ছবির ইমেজারিতে, আবহে, ছোট্ট ছোট্ট অনুষঙ্গে তাই কবিতা লগ্ন হয়ে ছিল তাঁর ছায়াছবিতে। এই যেমন ধরুন, ‘হাউসফুল’ (২০০৯) ছবিতে যে জোকারটা খুন করে বেড়ায়, সে খুনের পর ছড়িয়ে দিয়ে যায় হলুদ রঙের লিফলেট। নিবিষ্ট দর্শক দেখতে পান, তাতে লেখা একটি গদ্য কবিতা। যে কবিতা, এই সময়ের ক্ষতের কথা বলে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘চরাচর’ (১৯৯৪) ছবিতে বাপ্পাদিত্য সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে চিত্রপরিচালক হিসেবে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন ঋত্বিক ঘটককে, তাঁরই কাজের ধারা অনুসরণ করতেন। ঋত্বিকের প্রতি সেই শ্রদ্ধা তিনি জানিয়েছিলেন ‘হাউসফুল’ ছবিতে। বাপ্পাদিত্য এই ছবিতে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় চরিত্রের মধ্যে নিজেকে এবং ঋত্বিক ঘটককে একসঙ্গে মিলিয়েছিলেন অদ্ভুত এক মুন্সিয়ানায়। নিখিলের জামাকাপড় পরার ধরন, জুতো, পদবি সবকিছুর সঙ্গেই বাপ্পাদিত্যের দারুণ মিল, এমনকি বাপ্পাদিত্য পরিচালিত ‘কাঁটাতার’ ও ‘কাল’-এর পোস্টারে দেখা যায় পরিচালক হিসেবে নিখিলেরই নাম। সেই সব ছবির বাণিজ্যিক ব্যর্থতার কথা বলে পক্ষান্তরে নিজেকে মস্করা করতেও ছাড়েন না বাপ্পাদিত্য। নিজেকে নিয়ে মস্করা করা সহজ নয়, সেটা অনায়াসে বাপ্পাদিত্য করতে পেরেছিলেন এই ছবিতে। যাই হোক, ব্যর্থতার ফলে আপাদমস্তক ছবিয়াল নিখিলের সংসারে ভাঙন ধরে। ঋত্বিকের মতোই তার স্ত্রী কন্যাসন্তানের হাত ধরে একসময় তাকে ছেড়ে চলে যায়। সেই চলে যাওয়ার মধ্যেও নিখিল সুন্দর একটি সিনেমটিক ফ্রেম খোঁজে। দেখা যায়, নিখিলের নিজস্ব ঘরে ঋত্বিকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’ ছবির পোস্টার। বাস্তব আর ব্যঞ্জনা এভাবে একাকার করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল বাপ্পাদিত্যের।

ঋত্বিকের যেমন পরিশীলিত এবং পূর্বনির্দিষ্ট চিত্রনাট্য থাকত না, তেমনি থাকত না বাপ্পাদিত্যেরও। তাঁর একটা চিত্রনাট্য থাকত বটে; তাতে অনেক সময়ই অধিকাংশ সিনের ডায়লগ লেখা থাকত না। দৃশ্যগ্রহণের ঘন্টাখানেক আগে হয়তো সেটা লেখা হল—এমন ঘটনা বাপ্পাদিত্যের কাজে আকছার ঘটত। কিন্তু তিনি জানতেন কোথায়, কতটুকু কী করবেন। বাজেট সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। 

যা বলছিলাম, ঋত্বিক ও বাপ্পাদিত্যর বাঁধাধরা চিত্রনাট্য থাকত না। এই যেমন, ঋত্বিক ঘটক ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমার শ্যুটিং করছেন, সাঁওতাল পরগণায়। একদিন কোথায় ধামসা-মাদল বাজিয়ে ওঁরাওরা নাচগান করছে শুনতে পেলেন, ব্যস অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ছুটলেন সেখানে। এবং একখানা সিন তাঁদের মাঝখানে তুলে ফেললেন। এটা স্ক্রিপ্টে ছিল না, ভাবনাতেও ছিল না। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে দৃশ্যটি গড়ে তোলা হল, শ্যুট হল এবং ছবিতে স্থান পেয়ে গেল। ‘অযান্রিক’ ছবিতে যদি দেখেন, তাহলে খেয়াল করবেন, এমন একটা সিন আছে। বাপ্পাদিত্যের বেলাতেও এমন ঘটনা হামেশাই ঘটত। যেমন, ‘হাউসফুল’ ছবির শ্যুটিং হচ্ছে বসুশ্রী সিনেমা হলে। সেখানে দেখানো হচ্ছে যে, ব্যর্থ অথচ আদর্শবাদী পরিচালক নিখিল সাউথ রিমেকের বাজারে ভালো বাংলা ছবি তৈরির চেষ্টা করছে। সিঙ্গল স্ক্রিন একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাঁর ছবি হল পাচ্ছে না। পেলেও দেখা যাচ্ছে যে, প্রেক্ষাগৃহে একজোড়া প্রেমরত প্রেমিক-প্রেমিকা ও জন দুয়েক ছাড়া আর কোন দর্শক নেই। যাই হোক, এই সিনটা টেক করতে গিয়ে দেখা গেল যে, বসুশ্রী সিনেমার পেছন দিকে কালিকা সিনেমা ভাঙা হচ্ছে। সেটা মাথায় রেখে বাপ্পাদিত্য সঙ্গে সঙ্গে নতুন সিন লিখে ফেললেন। তাতে ডিস্ট্রিবিউটার সেই কালিকার ভগ্নস্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করছে নিখিলকে, জানাচ্ছে সিঙ্গল স্ক্রিন ভেঙে ফেলার কথা। দেখবেন, ছবিতে সিনটা একটা অসাধারণ ইম্প্যাক্ট তৈরি করেছে।

বাপ্পাদিত্য ‘সম্প্রদান’ (১৯৯৯) ছবি পরিচালনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রজীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে সাদামাঠা গল্প বলতে চলচ্চিত্রের আঙিনায় আসেননি, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় ছবিতেই। ছবির নাম, ‘শিল্পান্তর’। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছিলেন এই ছবি। এই ছবিতে মুখ্যভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শুভাশিস মুখার্জি ও দেবশ্রী রায়। দুজনেই অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। শুভাশিসকে এর আগে এমন স্মরণীয় চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কেউ আহ্বান জানাননি। স্ল্যাপ্সটিক কমেডির ধারায় বাংলা সিনেমায় তিনি বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বের করে তাঁকে অন্যধরণের চরিত্রে ভাবাটাই দারুণ ব্যাপার। বাপ্পাদিত্য সেটা ভাবতে পেরেছিলেন। আর শুভাশিসও তাঁর সমস্তটা দিয়ে এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। দ্বিতীয়বারের মতো তিনি এই সবটা দিয়ে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন ‘হারবার্ট’ ছবিতে। যাই হোক, ‘শিল্পান্তর’ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি মাস্টারপিস। এই ছবিটি দেশ-বিদেশের অনেক সম্মান আদায় করে নিয়েছিল। 

বাপ্পাদিত্য তাঁর চলচ্চিত্রজীবনে মোট দশটি ছবি পরিচালনা করেছেন। এই দশটি ছবিতেই তাঁর সম্পাদক দীপক মণ্ডল ও চিত্রগ্রাহক রাণা দাশগুপ্ত। অকৃত্রিম বন্ধুতা দিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁদের এই জুটি, যা শেষ ছবি পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। এই জুটিতে পরে সুরকার হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী অভিজিৎ বসু।

চিত্রপরিচালক হিসেবে তথাকথিত কমার্শিয়াল ছবির বাইরে অন্যধরণের ছবি করতে এসে বাপ্পদিত্যকে অনেক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রযোজক পাননি, ডিস্ট্রিবিউটার পাননি, হল পাননি; অনেক সময় ডিস্ট্রিবিউটার অজ্ঞতার সুযোগে ঠকিয়েছে—এমন কত ঘটনা ঘটেছে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন তিনি। যখন পেরেছেন নিজে প্রযোজনা করেছেন, অতি অল্প বাজেটে ছবি করেছেন। হাল ছাড়েননি। সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। সাউথ সিনেমার সিডি দেখে দেখে যখন বাংলায় কপি হচ্ছিল, বাণিজ্যিক ছবির বাজারে তুফান উঠেছিল; তখন আদর্শের ঘরে কুলুপ এঁটে বাজার ধরতে তিনি স্রোতের মুখে নেমে পড়েননি। বরং লড়াই করতে করতে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন নিজস্ব ধীর ভঙ্গিতে। নাটক-সিরিয়ালের ভালো অভিনেতাদের এনেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়। রুদ্রনীল ঘোষ ও সুদীপ মুখার্জির মতো সুঅভিনেতারা টিভি থেকে বাংলা সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন বাপ্পাদিত্যের মধ্য দিয়েই। তাঁর ‘কাঁটাতার’ ও ‘কাল’ ছায়াছবিগুলো সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। আর রয়েছে আমাদের সামাজিক ক্ষত ও অবক্ষয়ের দলিল হয়ে। এবং তার ধারক হয়েই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়ে যাবেন ক্ষণজন্মা চিত্রপরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।... 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...